তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে?
এই কি দাঁড়াচ্ছে না, যে, ওসমান গনির সমস্যার সঙ্গে আমাকে জড়িয়েছেন অধিকাচরণ। তাঁর উদ্দেশ্য কি ওসমান গনিকে সাবধান করা? এই কাজটি তো তিনি আমাকে না-জড়িয়ে করতে পারতেন। আমাকে জড়ালেন কেন?
লেখা এই পর্যন্তই। মিসির আলি হাই তুললেন। তাঁর ঘুম পাচ্ছে। এখন শুয়ে পড়লে হয়তো ঘুম এসে যাবে। তিনি হাত-মুখ ধুয়ে রাতের শেষ সিগারেটটি খেলেন এবং তাঁর খাতায় পেনসিল দিয়ে লিখলেন,
ওসমান গনির মৃত্যু একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমার ধারণা এই হত্যাকাণ্ডের নায়িকা তাঁর কন্যা নাদিয়া গান। ওসমান গনির স্ত্রীর মৃত্যু এই মেয়েটির হাতেই হয়েছে।
মিসির আলি অবাক হয়ে নিজের লেখার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হুট করে এই কথাগুলি কেন লিখলেন নিজেই জানেন না। হয়তো তাঁর উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। তাঁর হাতে কোনো যুক্তি-প্রমাণ নেই। তবু তাঁর মন বলছে, এই হচ্ছে ঘটনা। অম্বিকাচরণ বলে এক ভদ্রলোক ঘটনা জানেন। তিনি সাহায্য প্রার্থনা করছেন মিসির আলি নামের একজনের কাছে।
মিসির আলি ঘুমুতে গেলেন রাত একটার দিকে। অনেক দিন পর তাঁর সুনিদ্রা হল।
হোম মিনিস্টারের দর্শনপ্রার্থী
হোম মিনিস্টারের দর্শনপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক। সবাই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। ডাক্তারের চেম্বারের রুগীরা যেমন চাপা অশান্তি নিয়ে অপেক্ষা করে-সবার অপেক্ষার ধরন সে-রকম। কারণ মিনিস্টার সাহেব সবার সঙ্গে দেখা করছেন না! মিনিষ্টারের পি. এ. যে-ই আসছে তার নাম-ধাম এবং সাক্ষাতের কারণ লিখে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলছে, আজ মিনিস্টার সাহেব একটা ক্যাবিনেট মীটিং-এ যাবেন! আজ দেখা হবে না। অন্য আরেক দিন আসুন। এর মধ্যেও আবার কাউকেকাউকে বসতে বলছে। সরাসরি বলে দিলেই হয়—আপনার সঙ্গে মিনিস্টার সাহেব দেখা করবেন, আপনার সঙ্গে করবেন না।
মিসির আলি সাক্ষাতের কারণের জায়গায় প্রথমে লিখেছিলেন ব্যক্তিগত। পরমুহূর্তেই মনে হয়েছে সাক্ষাতের কারণ ব্যক্তিগত নয়। তিনি এসেছেন ওসমান গনি প্রসঙ্গে কথা বলার জন্যে। এটা কোনোক্রমেই ব্যক্তিগত নয়। কাজেই ব্যক্তিগত শব্দটি কেটে তার নিচে লিখলেন- ওসমান গনি প্রসঙ্গ। লেখার পর মনে হল, এই ওসমান গনি যে সেই ওসমান গনি তা কি মিনিস্টার সাহেব বুঝতে পারবেন? ওসমান গনি নামের আগে লেখা উচিত ছিল, বেহালাবাদক এবং শিল্পপতি ওসমান গনি। তাহলে আবার নতুন করে লিখতে হয়। পি. এ. ভদ্রলোক যদিও মাইডিয়ার ধরনের মানুষ, তবু তাঁর ধৈর্যেরও তো সীমা আছে।
মিসির আলি অন্যদের মতো অপেক্ষা করছেন। মিনিস্টার সাহেব ভেতরে ডেকে নেবার ব্যাপারে কী পদ্ধতি ব্যবহার করছেন তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। আগে এলে আগে যাবে এই পদ্ধতি নয়। অন্য কোনো পদ্ধতি কাজ করছে। যে- পদ্ধতিই হোক, সেই পদ্ধতিতে মিসির আলির নাম বোধহয় সবার শেষে। সবারই ডাক পড়ছে, শুধু মিসির আলির ডাক পড়ছে না। একটা বেজে গেছে। মিনিস্টার সাহেব নিশ্চয়ই দুপুরের খাবার খেতে যাবেন।
ঠিক একটা বাজতেই পি এ এসে বলল, আপনারা যাঁরা বাকি আছেন তাঁরা আগামী বুধবার আসুন। স্যার এখন লাঞ্চ ব্রেক নেবেন। তিনটায় স্যারের ক্যাবিনেট মীটিং আছে। মিসির আলি অন্যদের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। পি এ তাঁর কাছে এসে বলল, স্যার, আপনি বসুন। স্যার আপনাকে বসতে বলেছেন।
কতক্ষণ বসব?
তা তো স্যার বলতে পারছি না। চা খান, চা দিতে বলি।
বলুন।
মিসির আলি ভেবেছিলেন, এই দুপুরে নিশ্চয়ই শুধু চা দেবে না! ভর-দুপুরে খালিপেটে চা খাওয়া ঠিক না, তা মিনিস্টার সাহেবের পি এ নিশ্চয়ই জানেন।
চা আসার আগেই মিসির আলির ডাক পড়ল। হোম মিনিস্টার ছদারুদ্দিন হাসিমুখে বললেন, আসুন ভাই, ভাত খেতে-খেতে কথা বলি।
এটা শুধু যে ভদ্রতার কথা তা নয়, মিসির আলি লক্ষ করলেন, টেবিলে দুটা থালা সাজানো। মিনিস্টার সাহেব নিজেই টিফিন ক্যারিয়ার খুলছেন।
মিসির আলি সাহেব, বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসতে পারেন। সাবান, তেল, গামছা সব আছে। ইচ্ছা করলে গোসল সেরে ফেলতে পারেন। হা হা হা।
আপনি কি আমাকে সত্যি-সত্যি আপনার সঙ্গে খেতে বলছেন?
অবশ্যই।
এতটা ভদ্রতা কেন দেখাচ্ছেন জানতে পারি কি?
মিনিস্টার হলেই অভদ্র হতে হবে এমন কোনো কথা কি আছে?
না, তা নেই। সব সাক্ষাৎপ্রাথীকে আপনি নিশ্চয়ই দুপুরে আপনার সঙ্গে খেতে বলেন না?
না, সবাইকে বলি না। তবে একজনকে সবসময় বলি। আমার প্রবলেম হচ্ছে আমি এক খেতে পারি না। খাবার সময় কথা না বললে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। এই জন্যে যারা দেখা করতে আসে তাদের মাঝ থেকে একজনকে ঠিক করে রাখি, যার সঙ্গে ভাত খাব।
সেটা কীভাবে ঠিক করেন? অ্যালফাবেটিকেলি?
দেখুন। মিসির আলি সাহেব, খেতে বলেছি। খাবেন। এত কথা কেন?
মিসির আলি খেতে বসলেন। আয়োজন অতি সামান্য। পটল ভাজি, টেংরা মাছের ঝোল, ডাল। ভাতের চালগুলিও মোটা—মোটা। ইরি হবারই সম্ভবনা।
মিসির আলি সাহেব।
জ্বি,
খেতে পারছেন তো?
পারছি।
খাবারের মান ভালো না। কী করব বলুন-মিনিস্টার হিসেবে যা পাই তাতে এর চেয়ে ভালো খাওয়া সম্ভব না। অধিকাংশ লোকের ধারণা, আমরা রাজার হালে থাকি।
আপনি হয়তো থাকেন না, অনেকেই থাকে।
তাও ঠিক। সব পাখি মাছ খায়, দোষ হয় মাছরাঙার। আমরা হলাম মাছরাঙা পাখি। এখন বলুন, কি জন্যে এসেছেন আমার কাছে?