রিকশাওয়ালা।
জ্বে।
আপনার নাম কি ভাই?
কেরামত।
শুনুন ভাই কেরামত, আপনি আমাকে যেখান থেকে এনেছিলেন ঠিক সেইখানে নামিয়ে দিয়ে আসুন। আর হুডটা ফেলে দিন। আমার বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে যেতে ভালো লাগছে।
রিকশাওয়ালা রিকশা থামাল। সে অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। মিসির আলি লক্ষ করেছেন, রিকশাওয়ালদের মধ্যে এই একটা ব্যাপার আছে, তারা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছে, কখনো সেখানে যেতে চায় না। হয়তো কোনো এক কুসংস্কার তাদের মধ্যেও আছে। যেখান থেকে যাত্রা শুরু সেখানে ফিরে আসা যাবে না। ফিরে এলে চক্র সম্পূৰ্ণ হয়। মানুষ কখনো চক্র সম্পূৰ্ণ করতে চায় না। সে চক্র ভাঙতে চায়, কিন্তু প্ৰকৃতি নামক অজানা অচেনা একটা কিছু বারবার মানুষের চক্র সম্পূৰ্ণ করে দেয়। কোন করে?
তুমুল বর্ষণ হচ্ছে।
মিসির আলি ভিজছেন। ভালো লাগছে। তাঁর খুব ভালো লাগছে।
বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে
বৃষ্টিতে ভেজার জন্যেই হয়তো তাঁর জ্বর এসে গেল। বেশ জ্বর। তবে আরামদায়ক জ্বর। একধরনের জ্বরে শারীরিক কষ্ট প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। আরেক ধরনের জ্বরে শরীরে ভোঁতা ভাব চলে আসে। অনুভূতির তীক্ষ্ণতা থাকে না। গরম কম্বলের ভেতর ঢুকে আরাম করতে ভালো লাগে। ক্ষুধা নামক শারীরিক যন্ত্রণার হাত থেকেও সামীয়ক ত্ৰাণ পাওয়া যায়। কারণ এ-জাতীয় জ্বরে ক্ষুধাবোধ থাকে না।
রাত এগারটা। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে যাবার নির্ধারিত সময়। মিসির আলি নিয়ম ভঙ্গ করলেন। বিছানায় যাবার পরিবর্তে খাতা হাতে বসার ঘরে ঢুকলেন। গত কয়েকদিন ধরেই ওসমান গনি সম্পর্কে কিছু-কিছু নোট করেছেন। নোটগুলি পড়া দরকার। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে, তাঁর উচিত বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে যাওয়া। তিনি নিশ্চিত জানেন ঘুম আসবে না। গত দু রাত তা-ই হয়েছে। প্রায় সারা রাত জেগে কাটিয়েছেন। তার চেয়ে খাতা নিয়ে বসে থাকা ভালো। পড়তে-পড়তে একসময় হয়তো সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়বেন! নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা বোধহয় তাঁর ভাগ্যে নেই। মিসির আলি পড়তে শুরু করলেন
ওসমান গণি
ওসমান গনিকে আমি দেখি নি। কোটিপতি মানুষ। একজন বেহালাবাদক। যারা জন্ম থেকেই কোটিপতি এবং যারা পরবর্তী সময়ে কোটিপতি হয় তাদের প্রকৃতি ভিন্ন হয়? নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে যারা কোটিপতির পর্যায়ে আসে, তাদেরকে এক জীবনে দু রকম সমস্যার পড়তে হয়। অর্থকষ্টের সমস্যা এবং প্রচুর অর্থ দিয়ে কী করা যায়। সেই সমস্যা। ওসমান গনির ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। যাদের ক্ষেত্রে এটা ঘটে, তাদের মধ্যে সামান্য পরিমাণে হলেও ভারসাম্যহীনতা দেখা যায়। সাধারণ মানুষদের বেলায় তার চরিত্র ব্যাখ্যা করে বলে দেওয়া সম্ভব বিশেষ-বিশেষ পরিস্থিতিতে সে কী করবে। রেগে যাবে, আনন্দিত হবে, না দুঃখিত হবে। হলেও কী পরিমাণ হবে। কিন্তু ওসমান গনি জাতীয় মানুষ, যাঁরা দুটি ধাপ অতিক্রম করেছেন—তাদের ক্ষেত্রে আগেভাগে কিছু বলা সম্ভব না। চরিত্রে প্রেডকাটিবিলিটি বলে কিছু তাঁদের থাকে না।
ওসমান গনি সম্পর্কে ডাক্তার এবং পুলিশ বলছে-স্বাভাবিক মৃত্যু। তার কন্যা বলছে আত্মহত্যা তাঁর কন্যার বক্তব্যই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। এ-জাতীয় চরিত্রের মানুষদের কাছে জীবন একসময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। তারা একসময় ভাবতে শুরু করে, এ-জীবনে যা পাবার ছিল, সব পাওয়া হয়ে গেছে। আর কিছুই পাওয়ার নেই। আত্মহননের পথই তখন সহজ-স্বাভাবিক পথ বলে মনে হয়।
এ-পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটায় কোনো জটিলতা নেই। জটিলতা যিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁর নাম অম্বিকাবাবু! অম্বিকাবাবুর সঙ্গে আমার এখনো দেখা হয় নি। তিনি নতুন এক আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেই আস্তানা আমি খুঁজে বের করেছি। যদিও এখনো ঠিক করি নি, ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি দেখা করব কি করব না।
অম্বিকাবাবুর কন্যার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কন্যার বক্তব্য অনুযায়ী তার বাবা অসুস্থ। তাঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে না। অসুস্থ মানুষের সঙ্গে দেখা করতে না-দেওয়া মধ্যবিত্ত মানসিকতা নয়। মধ্যবিত্ত মানসিকতায় অসুস্থ মানুষদের সঙ্গেই বরং বেশি করে দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা আছে। মৃত্যুপথযাত্রী, যার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, তাকেও দল বেঁধে লোকজন দেখতে আসবে এবং জিজ্ঞেস করবে, এখন শরীরটা কেমন?
তবে মধ্যবিত্ত মানসিকতায় একধরনের অসুস্থ রুগী আছে, যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা হচ্ছে মানসিক রুগী। শরীরের রোগ আমরা দেখাতে তালবাসি কিন্তু মনের রোগ নয়। এই রোগ সম্পর্কে কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না।
পশুর মতো অম্বিকাবাবুকে গর্জন করতে আমি শুনেছি, তবে তা অভিনয়ও হতে পারে।
তার পরেও অম্বিকাবাবু যে একজন মানসিক রূগী তা ধরে নেওয়া যায়। মেয়ের কথানুযায়ী তিনি অনেকদিন থেকেই অসুখে ভুগছেনঃ একজন মানসিক রূগী আমাকে দিয়ে একটি চিরকুট লিখিয়ে নিল যে— সাবধানবাণী সেই চিরকুটে লেখা তা অক্ষরে-অক্ষরে মিলে গেল। কাকতালীয় ব্যাপার বলে একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আমার ধারণা, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে আমাকে সমস্যাটির সঙ্গে জড়ানো হয়েছে। ওসমান গনি নিজে এই কাজটি করতে পারেন, যাতে তাঁর মৃত্যু নিয়ে একধরনের রহস্য তৈরি হয়। কিন্তু তিনি তা করবেন বলে মনে হয় না। একজন অসম্ভব ধন্যবান ব্যক্তি, যিনি নিজের ভুবন নিয়ে ব্যস্ত, তিনি আমাকে চিনবেন তা আশা করা ঠিক না। তাছাড়া ভদ্রলোক নিভৃতচারী। তার চেয়েও বড়ো যুক্তি, আমার নোটটি পেয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু হোম মিনিস্টারকে টেলিফোন করেছিলেন।