- বইয়ের নামঃ মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
আপনি কি ভূত দেখেছেন
আপনি কি ভূত দেখেছেন স্যার? ইংরেজিতে যাকে বলে spirit, ghost, astral body মানে প্ৰেতাত্মার কথা বলছি, অশরীরী……
মিসির আলি প্রশ্নটির জবাব দেবেন কি না কিছু মানুষ আছে যারা প্রশ্ন করে, কিন্তু জবাব শুনতে চায় না। প্রশ্ন করেই হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। কথার ফাঁকে-ফোঁকে আবার প্রশ্ন করে, আবার নিজেই জবাব দেয়। মিসির আলির কাছে মনে হচ্ছে তাঁর সামনের চেয়ারে বসে থাকা এই মানুষটি সেই প্রকৃতির। ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক। গোলাকার মুখে পুরুষ্ট গোঁফ। কুস্তিগিরি-কুস্তিগির চেহারা। কথার মাঝখানে হাসার অভ্যাস আছে। হাসার সময় কোনো শব্দ হয় না, কিন্তু সারা শরীর দুলতে থাকে। ওসমান গনি নামের এই মানুষটির প্রধান বৈশিষ্ট্য অবশ্য নিঃশব্দে হাসার ক্ষমতা নয়; প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর নিচের পাটির একটি এবং ওপরের পাটির দুটি দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো! যে-যুগে রুট ক্যানালিং-এর মতো আধুনিক দন্ত চিকিৎসা শুরু হয়েছে, সে-যুগে কেউ সোনা দিয়ে দাঁত বাঁধায় না। এই ভদ্রলোক বাঁধিয়েছেন। ধবধবে সাদা দাঁতের মাঝে ঝকঝকে তিনটি সোনালি দাঁত।
কথা বলছেন না কেন স্যার, ভূত কি কখনো দেখেছে্ন?
জ্বি-না।
না-দেখাই ভালো। আমি একবার দেখেছিলাম, এতেই অবস্থা কাহিল। ঘাম দিয়ে জ্বর এসে গিয়েছিল। এক সপ্তাহের উপর ছিল জ্বর। পায়ের পাতা চুলকাতা ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল-অ্যালার্জি। ডাক্তারদের কারবার দেখুন, আমি বললাম, ভূত দেখে জ্বর এসে গেছে। তার পরেও ডাক্তার বলে অ্যালার্জি। হিষ্টামিন দিয়েছিল। অ্যান্টি হিষ্টামিন কি ভূতের অষুধ, আপনি বলুন?
মিসির আলি বললেন, আজ আমার একটু কাজ ছিল। বাইরে যাব। আপনি বরং অন্য একদিন আসুন, আপনার গল্প শুনব।
দশ মিনিট লাগবে স্যার। ভূতের গল্পটা বলেই চলে যাব। আমার সঙ্গে একটা মাইক্রোবাস আছে, আপনি যেখানে যেতে চান। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। রিকন্ডিশান্ড মাইক্রোবাস। গত আগষ্ট মাসে কিনেছি। দু লাখ পঁচিশ নিয়েছে।
মিসির আলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনি কি খুব অল্পকথায় আপনার ভূত দেখার গল্প বলতে পারবেন? যদি পারেন তাহলে বলুন, গল্প শুনব। খুব যে আগ্রহ নিয়ে শুনব তা না। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা ভূতের গল্প খুব আগ্রহ করে শোনে। আমার বয়স একান্ন। তার চেয়েও বড় কথা ভূত-প্রেতের ব্যাপারে আমার উৎসাহ কম।
আমারো কম। খুবই কম। গল্পটা বলে চলে যাই স্যার।
আচ্ছা বলুন। আপনি কি এই গল্প শোনাতেই এসেছেন?
দ্যাটস ক্যারেক্ট স্যার। আপনার ঠিকানা পেয়েছি আমার ভাগ্নির কাছ থেকে। সে বইটই পড়ে। বই পড়ে তার ধারণা হয়েছে আপনি দারুণ বুদ্ধিমান। অনেক বড় বড় সমস্যা নাকি সমাধান করেছেন। তখন ভাবলাম, যাই, ভদ্রলোককে দেখে আসি। বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ। গাধা টাইপের লোকের সঙ্গেও অবশ্যি কথা বলে আনন্দ পাওয়া যায়। যাদের বুদ্ধি মাঝামাঝি, এদের সঙ্গে কথা বলে কোনো আনন্দ নেই। আমি আসায় বিরক্ত হন নি তো?
না, বিরক্ত হইনি। আপনার কি কোনো সমস্যা আছে?
না, কোনো সমস্যা নেই। প্রথম দিন ভূত দুটাকে দেখে ভয় পেয়ে জ্বর হয়েছিল। এখন আর হয় না।
প্রায়ই দেখোন?
জ্বি-না। প্রায়ই দেখি না। ধরেন মাসে, দুমাসে একবার।
এরা আপনাকে ভয় দেখায়?
না, ভয় দেখায় না। গল্পটা তাহলে বলি—
সংক্ষেপ করে বলুন, আমার এক জায়গায় যেতে হবে।
আপনি স্যার কোনো চিন্তা করবেন না। আমার মাইক্রোবাস আছে। গত আগষ্ট মাসে কিনেছি। নাইনটিন এইটি মডেল…
মাইক্রোবাসের কথা আগে একবার শুনেছি। ভূতের কথা কি বলতে চাচ্ছিলেন বলুন।
ও হ্যাঁ—আমার হচ্ছে স্যার বিরাট ফ্যামিলি! পাঁচ মেয়ে সব কটার চেহারা খারাপ। মার মতো মোটা, কালো, দাঁত উঁচু। একটারও বিয়ে হয় নি। এদিকে আবার আমার ছোট বোনটি মারা গেছে—তার তিন মেয়ে এক ছেলে উঠে এসেছে আমার বাড়িতে। গোদের উপর বিষফোঁড়া। আমার মা, এক খালাও সঙ্গে থাকেন। বাড়িভর্তি মেয়ে। একগাদা মেয়ে থাকলে যা হয়, দিন-রাত ক্যাঁচ- ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় ভিসিআর। রোজ রাতে এরা দুটা করে ছবি দেখে। আমার মা চোখে কিছুই দেখেন না, তিনিও ভিসিআর-এর সামনে বসে থাকেন। শব্দ শোনেন। শব্দ শুনেই হাসেন-কাঁদেন। গলার আওয়াজ শুনে বলতে পারেন কে শ্ৰীদেবী, কে রেখা। এই হল স্যার বাড়ির অবস্থা।
মিসির আলি হতাশ গলায় বলেন, আপনি মূল গল্পটা বলুন। আপনি অপ্রয়োজনীয় কথা বেশি বলছেন।
মূল গল্পটা তাহলে বলি। বাড়ির মেয়েগুলির যন্ত্রণায় আমি রাতে ঘুমাই ছাদের চিলেকোঠায়। ছোট্ট ঘর খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে, শুধু বাথরুম নেই—এই একটা অসুবিধা। আমার আবার ডায়াবেটিস আছে, কয়েকবার প্রস্রাব করতে হয়। ছাদে প্রস্রাব করি। কাজের ছেলেটা সকালে এক বালতি পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। কাজের ছেলেটার নাম হল ইয়াসিন।
প্লীজ, গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করুন।
জ্বি স্যার, শেষ করছি। গত বৎসর চৈত্র মাসের ছয় তারিখের কথা। রাতে ঘুমাচ্ছি, প্রস্রাবের বেগ হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্প ছিল{ টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম। তখনি দেখি ঘরের কোণায় দুটা ভূত। খুব ছোট সাইজ, লম্বায় এই ধরেন এক ফুটের মতো হবে। গজ-ফিতা দিয়ে ম্যাপি নি। চোখের আন্দাজ। দু-এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হতে পারে।