কিন্তু বাস্তবে কী দেখতে পাচ্ছি? মানুষের কল্যাণের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ডাক্তার রোগীর গলা কাটছেন। অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে সেই গলাকাটা রোগীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা কামাই করছেন। বালি দিয়ে বাড়ি তৈরি করে ঠিকাদার কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করছেন। দলের হয়ে অন্যের গলা কাটছেন রাজনৈতিক টাউট–কেবল টাকার জন্যে। চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী বিনা মূলধনে কেবল পেশী দেখিয়ে কামাই করছে অঢেল অর্থ। সরকারী কর্মকর্তারা বেতনের বদলে কাজ করছেন উপরির জন্যে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে সেই প্রার্থী শুল্ক বিভাগে কাজ চান, নয়তো চান আয়কর বিভাগে। কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি টাকা। জ্ঞান বিতরণের কথা ভুলে গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথাকথিত শিক্ষা-ব্যবসায়ী টাকা করছেন। সমাজসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, স্রেফ টাকা করার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিতে নামছেন অসংখ্য লোক। এবং, একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে কাড়ি কাড়ি টাকা আনেন রাজনীতির সদর রাস্তা দিয়ে।
আমাদের একজন ফৌজী রাষ্ট্রপতিকে বলা হতো যে, এতো বড়ো পৃথিবীতে তাঁর নাকি মাত্র দুটি দুর্বলতা ছিলো–নারী আর অর্থ। দুটিই নাকি তিনি বেসুমার সংগ্ৰহ করেছিলেন। তবে তার নারীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি যে শত শত কোটি টাকা জমিয়েছিলেন–তা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিলো না। তখন তাকে আমার প্রায় পরম পূজনীয় এক অতিমানব বলে মনে হতো। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি যে, তিনি নাকি এখনকার দেশনায়ক/নায়িকাদের তুলনায় অপোগ— মাত্র। নাক টিপলে দুধ বের হয়।
এসব দেখে-শুনে সবাই এখন এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, রাজনীতির মতো লাভজনক ব্যবসা আর নেই। এমন কি, আপনি যদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারেন, তা হলেও আপনার কোটিপতি হওয়ার গ্যারান্টি থাকবে। সাংসদ হলে, কোটি-কোটিপতি। তার থেকেও বড়ো কোনো রাঘব বোয়াল হলে আপনি দেশটার একটা বড়ো অংশই গিলে খেতে পারবেন। এমন লাভজনক ব্যবসা হাতে রাখার জন্যে তাই ক্লিনিকে গিয়ে রাজনীতিকরা বিবেক ফেলে দিয়ে এবং নীতির মুড়িঘণ্ট ধুয়ে-মুছে-চেটে-পুটে খেয়ে সব কিছু করতে তৈরি থাকেন।
এই ব্যবসা করার জন্যে বেশি কিছু লাগেও না— প্রথমেই দরকার স্লোগান দেওয়ার লোক–যাদের ধরা যাক আমরা নাম দিলাম–পদাতিক সৈন্য। সহজেই তাদের ভাড়া করা যায়। যে টাকা দেবে, তার হয়ে এরা জিন্দাবাদ অথবা ধ্বংস হউক বলবে। তারপরে দরকার লাঠিয়ালদের সাজোয়া বাহিনী। তারপর খুনীদের কম্যান্ডো বাহিনী। তারপর সরকারী কর্মকর্তার আর্টিলারি। এই কর্মী বাহিনীর বেশির ভাগই জলের মতো (পানি বললাম না, কারণ তাঁরা নর্দমার দুৰ্গন্ধওয়ালা নোংরা জল–পান। করার উপযুক্ত নয়)। তাঁরা জলের মতো, কারণ যে-পাত্রে রাখিবেন, এই মাল সেই পাত্রের আকার ধারণ করবেন। যে-দল ক্ষমতায় আসুক সেই দলেরই ভাড়াটে সৈন্যের কাজ করিবেন। এসব বিল্ট-ইন ব্যবস্থা ছাড়া, দলের লোকেদের চাকরি দিয়ে আপনি প্রাইভেট আর্মিও গঠন করতে পারেন। লোকবল ছাড়া আপনার ব্যবস্থা করতে হবে প্রচারের জন্যে। এসবের ম্যানেজ করতে পারলে সামনের বার, ইনিশাল্লাহ, আপনি ক্ষমতায় আসতে পারবেন। এবং আসতে পারলে আপনার এতো টাকা হবে যে, আপনি নিজেই তার খেই হারিয়ে ফেলবেন। বোধ হয়, মরার সময়ে সন্তানদের সঠিক হিসেব দিয়ে যেতে পারবেন না।
কিন্তু কথা হচ্ছে, টাকা এলে সুখ-শান্তি আসবে কি? সরি! সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। আপনার পরিবার ভেঙে যেতে পারে। মানসিক শান্তি চলে যেতে পারে। দৈহিক পরিশ্রমে আপনি কাতর হতে পারেন। টেনশনে আপনার হার্ট অ্যাটাকিও হতে পারে। কিন্তু আপনার শত শত কোটি টাকা কেউ আটকাতে পারবে না।
কদিন আগে লন্ডনের এক রেস্টুরেন্টে বসে কবি এবং বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতো টাকা দিয়ে এই কোটিকোটিপতিরা কী করবেন? এতো টাকা কোন কাজে লাগবে? তিনি সংক্ষেপে বললেন, ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী মরার পর গুপ্তস্থানের লোমগুলোও কামিয়ে নিতে হয়। অর্থাৎ ওগুলোও সঙ্গে যাবে না–টাকা তো নয়ই!
বলতে পারেন: আপনার আর কতো টাকা চাই?
(যুগান্তর, ২০০৬)
৩৪. মৃত্যুর পর শান্তি আছে?
মরে শান্তি আছে কিনা, আমার পক্ষে বলা শক্ত। কারণ, আমি এখনো পুরোপুরি মরে যাইনি। স্বচক্ষে মৃত্যু-পরবর্তী অবস্থাটা দেখার অভিজ্ঞতা তাই হয়নি। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা কথা হলপ করে বলতে পারি–শান্তিতে মরার উপায় নেই। আজ হাঁটতে বেরিয়ে কথাটা মনে হলো। দেখি উল্টো দিক থেকে পোল্লায় দুটো ঘোড়ায় টানা একটা গাড়ি আসছে। ঘোড়া দুটো যমজ কিনা, খবর নিয়ে দেখিনি। কিন্তু দেখতে হুবহু একই রকম। দুটি বিশাল এবং খুব-সুরাত কালো ঘোড়া। ঘোড়া দুটো পারতো পক্ষে জোরেই দৌড়াচ্ছে। কিন্তু গাড়িগুলো আটকা পড়েছে তাদের পেছনে। ভাবলাম, গাড়িওয়ালারা ঘোড়া দুটো আর ঘোড়ার গাড়ির চালককে অভিশাপ দিতে দিতে যাচ্ছেন নিশ্চয়। ঘোড়ার গাড়ি কাছাকাছি এসে গেলো। দেখলাম অনেক যাত্রী যাচ্ছেন না। তাতে চড়ে, যাচ্ছেন একজন মাত্র যাত্রী। আর, অভিশাপ দিলেও তাঁর পক্ষে শোনার উপায়। নেই। আসলে, ভদ্রলোক অথবা ভদ্রমহিলা শেষ যাত্রা করছেন শান-শওকতের সঙ্গে। আর তো গাড়িতে চড়া হবে না।!–তাই মনের সুখে গাড়িতে চড়ে নিচ্ছেন।