আমাদের দেশে সর্বোচ্চ চাকুরে থেকে আরম্ভ করে চৌকিদার পর্যন্ত তাবৎ লোকই বোধ হয় কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এখন প্রাইমারিতে চাকরি পেতে হলেও এমএ পাশ করতে হয়। কাজেই অনুমান করি চৌকিদার সাহেবও কোনো পাশ দিয়ে থাকবেন। কিন্তু এই লাখ লাখ শিক্ষিত লোকের মধ্যে নীতির, মূল্যবোধের, সততার, সত্যবাদিতার, দয়ার, দক্ষিণ্যের, ত্যাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথবা থাকলেও তাদের বিদ্যার তুলনায় তা এতোই কম যে, তা অনুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়।
অথচ এখন থেকে কয়েক দশক আগেও শিক্ষার সঙ্গে আদর্শবাদের একটা যোগ ছিলো। দেশের লোকেদের শিক্ষিত করবেন–এই মহান ব্ৰত নিয়ে একজন শিক্ষক হতেন। ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ প্রচার করতেন। এখন প্রথমেই শিক্ষা-ব্যবসায় নামবেন। বলে ঘুস দিয়ে তথাকথিত শিক্ষক চাকরি জোগাড় করেন। টিউটরিয়াল হোম খোলেন। আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে একই সঙ্গে দু-তিন দল ছাত্রছাত্রীকে পড়ান। ক্লাসে না-পড়িয়ে বাড়িতে পড়ান। নিজের ছাত্রদের প্রশ্ন বলে দেন। ছাত্রদের পরীক্ষার খেয়া পার হবার উপায় বাৎলে দেন। কিন্তু শিক্ষা দেন না। সত্য কথা বলতে শেখান না। সৎ হওয়ার আদর্শ দেখান না তাদের। সমাজসেবার আদর্শ উচ্চারণও করেন না। বরং দফায় দফায় পড়িয়ে কিভাবে শিক্ষা-বাণিজ্য করা যায় নিজেই তার জলজ্যান্ত এবং অনুকরণীয় আদর্শ তুলে ধরেন শিক্ষার্থীর সামনে।
আগে সমাজসেবকরা রাজনীতিক হতেন। শিক্ষিত লোকেরা রাজনীতিক হতেন। গান্ধীজী, জিন্নাহ, নেহেরু, আবুল কালাম আজাদ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষ বসু, ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ, হরেন মুখোপাধ্যায়–সবাই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। সবাই দেশসেবা করেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়ে জমি-জমা কেনেননি। শিল্প-বানিজ্যের মালিক হয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেননি। বরং দয়া-দাক্ষিণ্যের জন্যে তারা বিখ্যাত ছিলেন। চিত্তরঞ্জন তার সমস্ত সম্পত্তি দান করেছিলেন দেশের কাজে। এমন কি, ব্যারিস্টারিও ছেড়ে দিয়েছিলেন দেশের কাজ করবেন বলে। ফজলুল হকও দয়ার জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। হরেন মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবার আগে ইংরেজিতে পিএইচডি করেছিলেন। তিনি জীবনযাপন করতেন অতি সাধারণ গরিব মানুষের মতো। মারা যাওয়ার সময় আঠারো লাখ টাকা দান করে যান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর হাসপাতালে। এখনও অনেক রাজনীতিক এমএ পাশ, পিএইচডি পাশ। কিন্তু রাজনীতি আর দুর্নীতি এখন প্রায় সমার্থক। যে-যতো বড়ো রাজনীতিক, তাঁর ততো প্রতিপত্তি। যতো বেশি প্রতিপত্তি, ততো বেশি দুর্নীতি। রাজনীতি মানে কোটি কোটি টাকা। রাজনীতি মানে অন্যের গলা কাটা। এখন শিক্ষার সঙ্গে আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষা আর নীতিহীনতার এখন নিত্য সহবাস।
(যুগান্তর, ২০০৬)
৩৩. কতো টাকা চাই?
লিও তলস্তয়ের একটি গল্প আছে, যার নাম: একজন মানুষের কতো জমি চাই? পেহম নামে একজন জমিহীন লোকের খুব লোভ ছিলো জমির জন্যে। ভাগ্যক্রমে একটু একটু করে খানিকটা জমি পেয়েও গেলো সে। কিন্তু তার আরও জমি চাই। শেষে অপরিচিত একটি এলাকায় গিয়ে সে অঞ্চলের মালিকদের খুশি করে অনেক জমি পাওয়ার অঙ্গীকার পেলো সে। এই মালিকদের মোড়ল পেহমকে বললেন, ঠিক আছে, তুমি সারা দিনে যতোটা জায়গা বেড় দিয়ে আসতে পারবে, সবটাই তোমার হবে। পরের দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো। সেই লোকটি–একটা টিলার মাথা থেকে। বেশ খানিকটা দূরে দূরে চিহ্ন দেওয়ার জন্যে সে সঙ্গে নিলো একটা কোদাল। অনেক লোভ তার। কখনো হেঁটে, কখনো দৌড়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেলো সে। দারুণ ক্লান্ত হয়ে সে দুপুরের পর রুটি খেলো। একটু শক্তি পেয়ে আবার চললো পুরো দমে। তারপর যখন মনে পড়লো, যেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিলো, সেখানে ফিরে যেতে না পারলে এ জায়গার একটুও তার হবে না, তখন ক্লান্ত দেহ নিয়ে সে আবার পেছনের দিকে ছুটতে আরম্ভ করলো। ওদিকে, সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে দিগন্তের দিকে। লোকটিও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। তারপর সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু যখন মিলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন সে ফিরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। যেখানে একটা টুপি রেখে সে যাত্রা শুরু করেছিলো ঠিক সেখানে। যে-এলাকা সে বেড় দিয়ে এসেছিলো, সেই বিত্তীর্ণ এলাকা তারই, একান্ত তারই হয়ে গেলো। ভৃত্যু এসে তাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। রক্ত বমি করে সে ত্যাগ করলো তার শেষ নিশ্বাস। কোদাল দিয়ে ভৃত্য তার জন্যে ছফুট লম্বা একটি কবর খুঁড়লো। সেই ছোট্টো জায়গাটুকুই কাজে লাগলো পেহমের।
সত্যি আমাদের দেশে চারদিকে মানুষ যেভাবে পাগলের মতো জমি কিনছে, সৎ-অসৎ উপায়ে মানুষের গলা কেটে; বিবেক বিসর্জন দিয়ে টাকা করছে, তাতে অনেক সময়ই আমার তলস্তয়ের এই গল্পটা মনে পড়ে। কতো জমি চাই আর! কতো টাকা চাই! দশ লাখ, বিশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ! আর কতো চাই? ছেলেবেলায় বাবার মুখে একজনের কথা শুনেছিলাম যে, তিনি নাকি লা—খপতি। বাবার বলার মধ্যে সম্রামের চিহ্ন ছিলো, আর আমার চোখে ছিলো বিস্ময়ের দৃষ্টি। এখন লাখ টাকা খুব বেশি টাকা নয় বাংলাদেশে, ঠিকই। ধরলাম আগের লাখ টাকা এখন কোটি টাকা। এবং একজন এক কোটি টাকার কম হলে কিছুতেই নিরাপদ বোধ করতে পারছেন। না। ঠিক আছে; অতএব আমাদের উচ্চাশার সীমানা এক কোটিতে বেঁধে দিচ্ছি। না, তার চেয়েও বেশি।–দশ কোটিতে বাঁধছি।