কিন্তু বাঙালি শক্তের ভক্ত। তাই উপকারী জন্তুদের নিন্দা করলেও, যেসব জন্তু হালুম করে তাদের ওপর আক্রমণ করে–যেমন বাঘ এবং সিংহ, তাদের প্রতি বাঙালিদের প্রচুর ভক্তি লক্ষ্য করা যায়। যেমন, সাহসী এবং দৃঢ় চরিত্রের লোক হলে তাকে বলা হয়, বাঘের মতো। অথবা বাঘা। বাঘা যতীন যেমন। তার চেয়েও এক কাঠি সরেস হলে, তাকে তুলনা করা হয় সিংহের সঙ্গে। এই দুই শক্তিশালী এবং নরঘাতী পশুর প্রতি তাদের ভক্তি এতো প্রবল যে, এদের নামের সঙ্গে বাচ্চা কথাটা জুড়ে দিলে সেই ব্যক্তির আরও বেশি গৌরব প্রকাশ পায়–যেমন বাঘের বাচ্চা, সিংহের বাচ্চা, সিংহশাবক। শিয়াল হালুম করে আক্রমণ করে না। আবার মানুষের ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকারও করে না। তাই শিয়াল কথাটা প্ৰায় নিউট্রাল। শিয়াল বলে গাল দিলে কাউকে প্রশংসা করা যায় না ঠিকই, কিন্তু খুব ছোটোও করা হয় না। কেউ বেশি চালাক অথবা কূটবুদ্ধির অধিকারী বোঝাতে হলে আমরা তাকে শিয়ালের সঙ্গে তুলনা করি। শেয়াল পণ্ডিত অথবা শেয়ালের মতো ধূর্ত বলে বর্ণনা দিই। হালুম করে আক্রমণ না-করলেও ফোস করে আক্রমণ করে সাপ । সাপ একটা ব্যতিক্রম। সাপকে মানুষ খুবই ভয় করে বটে, কিন্তু সাপের সঙ্গে তুলনা দিয়ে কোনো মানুষকে প্রশংসা করার রীতি নেই। বরং কেউ অপ্ৰত্যাশিতভাবে রাগ করে উঠলে বলি ফোস করে ওঠা। তেমনি অত্যন্ত খারাপ শক্রিকে বলি কালকূট। দুমুখো সাপও মানুষের চরিত্রজ্ঞাপক।
মোট কথা, বাংলা ভাষা যেমন অযৌক্তিকভাবে নারীদের ছোটো করে দেখে, নিরীহ পশুদেরও দেখে তেমনি ছোটো চোখে। বিবেকবান ব্যক্তিদের উচিত সবাই মিলে এর একটা প্ৰতিকার করা। এ ব্যাপারে সহায়তা ও সহযোগিতা করার জন্যে পশুক্লেশ নিবারণী সভাগুলোর কাছে আবেদন করা উচিত। সেটা যতো দ্রুত হয়, ততোই পশুদের জন্যে ভালো। আমরাও বিবেককে তা হলে সাফ রাখতে পারি।
(যুগান্তর, ২০০৬)
৩২. বিদ্যা ও বিশ্বাস
মনে মনে আমরা কতোগুলো জিনিশ আগে থেকেই ধরে নিই। যেমন, উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ ভদ্র হবেন বলে আমরা প্ৰত্যাশা করি। একজন ধাৰ্মিক লোক সৎ হবেন–এও আমরা আগে থেকেই ভেবে রাখি। কিন্তু কাৰ্যকালে আমাদের ধারণা যে সব সময়ে সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ উপাধিধারী একজন লোক হয়তো অসভ্যোর মতো আচরণ করেন। মস্ত উপাধিধারী একজন বিজ্ঞানী হয়তো কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন। অনেক সময়ে তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা অশিক্ষিত লোকের চেয়েও বেশি মূর্খতার পরিচয় দেন। আমরা তখন দুঃখ করে বলি— উপাধি থাকলেও অমুক লোকটি আসলে মুর্থ। এটা কী করে সম্ভব? ছেলেবেলা (অথবা তসলিমা নাসরীনের ভাষায় মেয়েবেলা) থেকে আরম্ভ করে ষোলো-সতেরো-আঠারো (সেশন জটের ওপর নির্ভরশীল) বছর ধরে অনেক পড়ালেখা করে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ করে প্রথম, দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় (নকলের যুগে তৃতীয় শ্রেণী কি এখনো আছে?) শ্রেণীতে পাশ করে তারপর এক-একজন অশিক্ষিতের মতো আচারণ করে কী করে? অতো বছর যে গদ্যে-পদ্যে এতো শ্লোক আওড়ালো, তার কি কোনো আছরই হলো না কঠিন হৃদয়ের ওপর? এ জন্যেই ধর্মগ্রন্থে সম্ভবত বলা হয়েছে, এদের কানে (আসলে হৃদয়ে) তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরা তোতা পাখির মতো পড়া মুখস্থ করে, কিন্তু তাদের দিলে তা কোনো আঁচড় কাটে না। ডিগ্রি আর বিদ্যা আসলে ভিন্ন বস্তু। বিদ্যা আর বিশ্বাসও আলাদা।
একটা উদাহরণ দিই। অনেক বছর আগে এক শিশু-বিশেষজ্ঞের কাছে অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক বিদেশ থেকে উচ্চ উপাধি নিয়ে এসেছিলেন। শিশু-চিকিৎসায়। সামান্য জ্বর এবং সেই সঙ্গে পেটের অসুখ। শিশুটির বয়স আড়াই বছর। ওষুধ দিলেন। বলেন, খাওয়ান আর আল্লাহ আল্লাহ করেন। উদ্বিগ্ন বাবা আল্লাহ আল্লাহ করতেই পারি, কিন্তু সে উপদেশ ডাক্তারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করিনি। তাঁর কাছে গিয়েছিলাম দোয়ার জন্যে নয়, দাওয়াইয়ের জন্যে। আল্লাহআল্লাহ ছাড়াই দুদিনের মধ্যে শিশুটির পেটের অসুখ ভালো হলো। জ্বরও কমে গেলো। কিন্তু গায়ের তাপমাত্রা নেমে গেলো ৯৬ ডিগ্রিতে। বিচলিত হয়ে ডাক্তারকে ফোন করলাম। ডাক্তার বললেন, গায়ে একটু বেশি কাপড়চোপড় পেঁচিয়ে রাখুন। আর আল্লাহ আল্লাহ করুন। কিন্তু ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন না। স্যালাইন দেওয়ার কথাও বললেন না। তারপর সারা রাত ধরে যমে মানুষে যে টানাটানি হলো, সে কথা এখানে অবান্তর। উচ্চশিক্ষা যে ডাক্তারকে মানুষ করতে পারেনি, সেটাই বড়ো কথা।
আমাদের দেশে শিক্ষার হার এখন আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষার তুলনায় উচ্চশিক্ষা ছড়িয়েছে অনেক বেশি। অপরিকল্পিত শিক্ষার ফলেই দেশে এতো শিক্ষিত বেকার। এতো শিক্ষিত বেকার বলেই চারদিকে এতো চাঁদাবাজ, এতো রাজনৈতিক “নেতা-কর্মী।” (অর্থাৎ টাউট), এতো হাইজ্যাকার, এতো সন্ত্রাসী। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এতো দুর্নীতি এবং অপরাধ। কয়েক মাস আগে এক ভূমি রেজিষ্ট্রোরের এজলাশে যেতে হয়েছিলো কপালের ফেরে। নিজের চোখে দেখলাম অন্তত পচিশ জন লোকের ভিড়ের মধ্যে মহামান্য রেজিস্ট্রর সাহেব হাত বাড়িয়ে ঘুস নিলেন। এ রকমের চোখের চামড়াহীন ঘুসখের আমি জীবনে দেখিনি। কিন্তু ভদ্রলোক এমএ পাশ। বুঝলাম, শিক্ষা তার মনে সততার কোনো ছাপ এঁকে দেয়নি। সাধারণ লজ্জার মনোভাবও নয়। এর থেকে বেশ্যারও চক্ষুলজ্জা বোধ হয় বেশি থাকে।