মোট কথা, মর্মঘাতী এবং ক্রমবর্ধমান প্ৰেমরোগের সফল অথবা ব্যর্থ— কোনো রকম চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নাই। অতএব, এই ব্যাধির ব্যাপারে ঔষধের কোম্পানিগুলির কি অধিকতর সচেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয় নহে? এই পীড়ার জুতসই একটি বটিকা–এমন কি, তিক্ত স্বাদের কোনো তরল মিকশ্চার বাহির হইলেও তাহা যে লোকে লাইন লাগাইয়া কিনিবেন, সে বিষয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশ আছে বলিয়া সমাজসচেতন কোনো ব্যক্তিই মনে করিবেন না। কারণ, প্রেমে পড়িলে তাহাকে বেশ কষ্টকর অভিজ্ঞতা বলিয়া মনে হয়। অনেক সময়ে রীতিমতো হৃদয়বিদারক বলিয়াও মনে হইতে পারে। অতএব এই রোগের ঔষধ যতোই তিক্ত হউক, যতোই দুর্মুল্য হউক, যতোই দুর্লভ হউক, লোকে তাহা সংগ্ৰহ করিতে চেষ্টার ক্রুটি রাখিবে না। কিন্তু গলদ একেবারে গোড়ায়। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, ভেজস কোম্পানিগুলি এই রূপ একটি ঔষধ আবিষ্কারের নিমিত্ত উদ্যোগী হইবার কোনো লক্ষণ দেখাইতেছে না। আমার বিবেচনায় সকলে মিলিয়া এখন মাননীয় গবর্নমেন্টের দরবারে দরখাস্ত দিবার প্রয়োজন দেখা দিয়াছে। কিন্তু একমাত্র আমার বিবেচনার উপর নির্ভর করিতে না-পারিলে এই বিষয় বিবেচনা করিবার নিমিত্তে অবিলম্বে একটি সর্বদলীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হউক।–এই বিষয়ে স্বদেশ হিতৈষীগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য: কোন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গভর্ণমেন্ট বাহাদুর প্রেমের প্রতিকারের নিমিত্ত অৰ্থ বরাদ্দ করিবেন, তাহা কবে বাস্তবায়িত হইবে এবং সাংসদ মহোদয় ও তাঁহাদের তাবেদারগণ ঐ অর্থের কতোটা অনৰ্থ করিবেন এবং তাহার ফলে প্ৰেম-ব্যাধির সম্ভাব্য ঔষধ কতোটা কার্যকর হইবে, তাহার কোনো নিশ্চয়তা নাই। ইতিমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা বাড়িয়াই চলিতেছে। তাহাদের কি বলিয়া সাত্ত্বনা দেওয়া হইবে? ভাবিয়া আমি কোনো কুলকিনারা দেখিতেছি না। কি করিব? কি বলিব? ইতিবাচক একমাত্ৰ যাহা মনে পড়িতেছে, তা অতি প্রাচীন কালের এক বিখ্যাত কবির উক্তি। ইহা একটি প্রাকৃত ভাষার গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। এই কবির উক্তিই একমাত্র ভরসা। প্ৰেমরোগ থেকে আরোগ্য লাভ করিবার পর নিজের অভিজ্ঞতা দিয়া এই কবি বলিয়াছেন যে, প্ৰেম চলিয়া যায়।
পিশুনজনের জল্পনায়, হায়, প্রেম চলে যায়,
প্ৰণয়ের কোমল কুসুম যায় ঝরে
অতিদর্শনের বন্যা এসে
প্রেমের প্রবীণ বৃক্ষ তাকেও উপড়ায়—
এমন কি, একেবারে অকারণে প্ৰণয়ের মহীরুহ কুপোকাত হয়।)
(প্ৰথম আলো, ২০০৭)
৩১. পাশবিক ভাষা
দাবি আদায়ের জন্যে ঘেরাও এখন একটা জনপ্রিয় পদ্ধতি। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে পশুরাও যে এ কৌশল শিখে ফেলেছে, সেটা জানা ছিলো না। সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম ভালো মানুষের মতো। কোনোদিকে তাকাইনি। কারো সঙ্গে তর্কে যাইনি। এমন কি, অনিচ্ছায়ও কাউকে ধাক্কা দিইনি। রীতিমতো ভদ্রলোক। তারই মধ্যে আমাকে হঠাৎ ঘিরে ধরলো একদল পশু। আমার চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো: আমি খুব ভীতু। পালিয়ে বাঁচার শিক্ষায় বিশ্বাসী। তাই প্রথমেই দৌড় দেওয়ার কথা মনে হলো। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম পশুরা যে-দুৰ্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করেছে, তাতে পালানো অসম্ভব। তাই মুখে সাহসের হাসি ফুটিয়ে পশুদের জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার?”
চারদিক থেকে হুহুঙ্কার শোনার জন্যে তৈরি হলাম। কিন্তু মানুষের মতো সবাই মিলে তারা এক সঙ্গে হৈচৈ করে উঠলো না। তাদের মধ্য থেকে–বুঝতেই পারছেন কে হতে পারে!:–হ্যাঁ, শেয়াল পণ্ডিত! সে এগিয়ে এসে কথা শুরু করলো আমার সঙ্গে। যেভাবে সে কথা বললো তাতে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। একদম মানুষের মতো নয়!–তার বক্তব্য সে পেশ করলো বিনয়ের সঙ্গে, ভদ্র ভাষায়, অনুচ্চ কণ্ঠে এবং যুক্তি দিয়ে। সে বললো, মানুষ যেভাবে উঠতে বসতে নিরীহ পশুদের চরিত্রহানি করছে, তাতে তারা আর স্থির থাকতে পারছে না। এর প্রতিকার চায় তারা। মানুষের মধ্য সবাই যে ভালো নয়, তারা তা জানে। কিন্তু খারাপ লোকেদের নিন্দা করতে গিয়ে মানুষরা পশুদের সঙ্গে তাদের কেন তুলনা করে–এটা তারা একেবারেই বুঝতে অক্ষম। কিছু বলার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেলো। বুঝতে পারলাম আগের দিন চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশুদের দেখে নিশ্চয় এ কথা আমি অবচেতন মনে ভেবে থাকবো। রাতের বেলা সেটাই স্বপ্ন হয়ে ফিরে এসেছিলো আমার কাছে।
কেউ অকল্পনীয় অনাচার অথবা নির্যাতন করলে, নিন্দা করে আমরা বলি পাশবিক। অনেক সময় পশু বা জানোয়ার বলেও গাল দিই। কদিন আগে মাদ্রাসার এক শিক্ষকের অত্যাচারের একটি কাহিনী পড়লাম এক দৈনিক পত্রিকায়। দশ বছরের একটি বালিকাকে এক শোরও বেশি বেত্ৰাঘাত করে এই হুজুর বীরত্বের অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন। পত্রিকা এই খবরের শিরোনাম দিয়েছে: পাশবিক। মাদ্রাসার এই শিক্ষক–যাকে অনায়াসে বলতে পারি শিক্ষককুলের কলঙ্ক— ঐ পত্রিকার মতে তিনি পশুর মতো আচরণ করেছেন। কিন্তু খবরটা পড়ার পর হুজুরের কীর্তি বর্ণনার জন্যে ঐ শব্দটাকে মোটেই প্ৰযোজ্য বলে মনে হলো না। কারণ কোনো পশু মানুষের সঙ্গে এমন অমানুষের মতো আচরণ করে না।
পশু শব্দটার বিশেষণ হলো পাশবিক। তার মানে পশুর মতো অথবা পশুর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। সব পশু কি খারাপ নাকি? ধরা যাক, একটা গরু? খারাপ? কিন্তু পাশবিক শব্দটি যেভাবে আমরা ব্যবহার করি, তাতে পশুদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষই প্ৰকাশ পায়–বর্ণবিদ্বেষের মতো। পাশবিক কথাটার কদৰ্থ করি আমরা। আমরা পশুর ভালো গুণগুলি বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল খারাপ দিকটাই বোঝাই এ শব্দ দিয়ে। এটাকে আর যা-ই বলি, মানবিক সুবিচার বলতে পারিনে। কারণ আমাদের পরিচিত অনেক পশুই আমাদের ক্ষতি করা তো দূরের কথা, আমাদের খুবই উপকার করে। তা ছাড়া, কোনো পশু কি সত্যি সত্যি মাদ্রাসার ঐ হুজুরের মতো এমন নিষ্ঠুর? মানুষের সঙ্গে দূরের কথা, কোনো পশু কি অন্য একটা পশুর সঙ্গেও এমন নিৰ্মম আচরণ করে? যদি করার কোনো প্রমাণ না-থাকে, তা হলে বড়ো জোর বলা যেতে পারে হুজুরের ব্যবহার অমানুষের মতো। কিন্তু এর মধ্যে পশুকে টেনে এনে পশুদের হেয় করার কোনো যুক্তি আছে?