রোগ লক্ষণ
এই ব্যাধি হইলে মনের মধ্যে হা-হুতাশ আরম্ভ হয়। বিশেষ একজনের প্রতি অতীব আকর্ষণ ও মনোযোগ দেখা দেয়। তাহার নয়নের সহিত একবার নয়ন মিলাইতে, তাহার সহিত অর্থহীন বাক্যালাপ করিতে, তাহার মনোযোগ লাভ করিতে হৃদয় অত্যন্ত আকুল হইয়া উঠে। তাহা ছাড়া, তাহার স্পর্শ লাভ করিবার জন্য (এমন কি তাহার সঙ্গে দেহ-মন অভিন্ন করিবার জন্য) হৃদয় আই-ঢাই করিতে থাকে। (জনৈক বৈষ্ণব কবি লজ্জা-শরমের মাথা খাইয়া এই ইচ্ছাকে প্রতি অঙ্গ লাগি প্ৰতি অঙ্গের ক্ৰন্দন বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। কথাটা অসঙ্গত নহে। ইচ্ছাটা কতকটা ঐ রকমই হয় বটে। কিন্তু তিনি মধ্যযুগে যাহা অমন অসংকোচে বলিতে পারিয়াছেন, তথাকথিত আধুনিক রুচিবশত আমি তাহা বলা হইতে নিবৃত্ত থাকিলাম।) এই বিশেষজনটি দৃষ্টির আড়ালে গমন করিলেই হৃদয়ের অভ্যন্তরে হাহাকার আরম্ভ হয়। ইহার যথার্থ নাম বিরহ। অতিশয় কঠিন রোগ। এতই কঠিন যে, ইহার শেষ দশা হইল মৃত্যু। কিন্তু সে কথা এখানে থাকুক।
যাহার প্রতি এই অদ্ভুত এবং অহেতুক আকর্ষণ সৃষ্টি হয়, তাহার কোনো মন্দ দিক এই সময়ে দৃষ্টিতে আইসে না। পঙ্গু-পায়ে তাহার খোড়াইয়া চলাকেও এই সময়ে ভারতনাট্যমের মতো মনোহর মনে হইতে পারে। তাহার ত্বকের বর্ণ কৃষ্ণ হইলেও অতঃপর সেই রঙকেই বিশ্বের সর্বোত্তম রঙ বলিয়া ধারণা জন্মে। ধূসর মেঘ, ঘোলাটে জল, সবুজ পাতা— সব কিছুকেই তখন সেই রঙ বলিয়া ভ্ৰম হয়।
এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির আচার-আচরণ এবং প্রত্যাহিক ব্যবহার এই সময়ে আমূল বদলাইয়া যায়। এই চন্দ্ৰে-পাওয়া ব্যক্তিরা এই সময়ে এমন এক-একটা অদ্ভুত কাজ করিয়া বসেন যাহা অন্য সময়ে কখনোই করিবার কথা ভাবিতেন না। অথবা নিদেন পক্ষে সেই কর্মকে হাস্যকর মনে হইত। বস্তুত, এই আচরণকে পাগলামি বলিলে অত্যধিক বলা হয় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হইতেছে, এই পাগলামি যে করে, তাহার নিজের নিকট ইহাকে খুবই স্বাভাবিক বলিয়া মনে হয়।
জনপ্রিয় ধারণা হইল যে, ইহা হৃদয়ঘটিত রোগ। কিন্তু হৃদরোগবিশেষজ্ঞরা ইহাকে আদৌ হৃদরোগ বলিয়া স্বীকার করেন না। কেন করেন না, তাহারা ভালো বুঝেন। সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হইলে অনেকে তাঁহাদের হৃদয়ে একটা কেমন কেমন চিনচিনে বেদনা অনুভব করেন। ফলে কখনো কখনো বুক চাপিয়া ধরেন। হৃদয়ে হামলা হইলে অর্থাৎ হার্ট অ্যাটাক হইলে যেমন কেহ চাপিয়া ধরে–তেমন। এতদ্ব্যতীত, এই রোগ হইলে মধ্যে মধ্যে হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়া যায়। ইহাকে হৃদরোগের ভাষায় ট্যাকি কার্ডিয়া বলা হয়। শ্বাস-প্ৰশ্বাস। ঘন ঘন হইতে থাকে। আর প্রায়শ নিজের অনিচ্ছায় এবং অজ্ঞাতে ফোস ফোস করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পড়িয়া থাকে। এই সব লক্ষণ হইতে সাধারণ মানুষের ধারণা হইতেই পারে যে, ইহার সহিত হৃদরোগের অন্তরঙ্গ যোগাযোগ রহিয়াছে। কিন্তু আগেই বলিয়াছি, হৃদরোগবিশেষজ্ঞরা এই কথা স্বীকার করেন না।
অনেকে বলেন, ইহা মনের রোগ। হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞদের ইহাতে কোনো আপত্তি নাই। তবে হৃদরোগ হইলে অস্ত্ৰোপচার করিয়া তাহার চিকিৎসা করা যায়। মুশকিল হইল, মনটা শরীরের কোন স্থানে অবস্থিত, বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সত্ত্বেও তাহা কেহই জানে না। সুতরাং চিকিৎসকগণ প্ৰেমরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের দেহের সেই স্থানে খোচাইয়া কোনো পদাৰ্থ বাহির করিয়া বায়ল্পি করিয়া পরীক্ষা করিবেন, তাহার উপায় নাই। তাহা না-হইলে জীন-প্ৰযুক্তি অথবা ঐ ধরনের কোনো অত্যাধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়া হয়তো ইহার কথঞ্চিৎ প্রতিকার সম্ভব হইত। হৃৎপিণ্ডের অবস্থান এবং তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যাদি ডাক্তারগণ ভালো করিয়া জানেন। সেই হেতু কাটাকুটি করিয়া তাহারা ব্যৰ্থ অথবা আশিংক বিগলিত হৃৎপিণ্ডকে মেরামত করিতে পারেন। কিন্তু মনের অবস্থান না-জানায় শৈল্যচিকিৎসার দ্বারা প্ৰেমরোগ ভালো করিবার কোনো পন্থা অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
অনেকে মনে করিয়া থাকেন যে, হৃদয়ের নয়, এই রোগ প্রকৃত পক্ষে মস্তিষ্কের। কারণ, মানুষ মস্তিষ্কের সাহায্যেই প্রেমিক/প্রেমিকার ধ্যান করিয়া থাকে। এই ব্যাধিকে অতএব অনেকে মস্তিষ্ক বিকার বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছেন। তাহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা কমবেশি পাগল। ইলেক্টিক শক দিয়া পাগলামির চিকিৎসা অনেক সময় সাফল্যের সঙ্গে হইয়া থাকে। কিন্তু প্ৰেমরোগ হইয়াছে চিকিৎসকগণ এই রূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইলে সেই পাগলকে ইলেক্টিক শক দিবার বিধান দেন না। বরং অভিভাবকরা প্ৰচণ্ড ধমক দিলে অথবা প্রেমিক/প্রেমিকা বিশ্বাসঘাতকতা করিলে এই বিকার প্রশমিত হয়।
অনেকে বলেন, এই রোগ এক প্রকারের জুর। শরীরের কোনো স্থানে কোনো বিকার ঘটিলে, সংক্ৰামক রোগ হইলে অথবা ভাইরাসের আক্রমণ হইলে যেমন দেহের উত্তাপ বৃদ্ধি পায়, প্রেম রোগে আক্রান্ত হইলে তেমনি মনের উত্তাপ বাড়িয়া যায়। মুশকিল হইলো: জুর হইলে তাপ-কাঠি দিয়া উত্তাপের পরিমাপ করা যায়। কিন্তু প্ৰেমজুর হইলে তাহা মাপিবার মতো কোনো থার্মোমিটার অদ্যাবধি বাজারে ছাড়া পায় নাই। আবিকৃত হইয়াছে বলিয়াও শোনা যায় নাই। তাহা ছাড়া, সাধারণ জুর প্যারাসিটামলে দ্রুত কমিয়া যায়, কিন্তু প্ৰেমজুরের তেমন কোনো বটিকা নাই। রোগাক্রান্তের মস্তকে ঘটি ঘটি জল ঢালিলেও এই জুরের উপশম হয় না। অবশ্য কেহ। কেহ বলিয়া থাকেন যে, মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া গাধার পৃষ্ঠে চড়াইলে ক্ষেত্র বিশেষে কিছু উপকার জন্মে। কিন্তু ইহা পরীক্ষিত সত্য নহে।