একটি-দুটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা আরও হৃদয়গ্রাহ্য হইতে পারে। দীর্ঘ কাল আগে নহে; মার্কিন মুলুকের রাষ্ট্রপতি কিল্টন মহাশয় এই রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। প্রেমের অমৃত তুলিবার জন্য পুরুষরা যেসব অস্ত্ৰ ব্যবহার করে, তিনি তাহার অধিক–দুর্মুল্য সিগার পর্যন্ত ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি লেজে-গোবরে হইয়াছিলেন। ব্রিটেনের এক রাজাও এই রোগাক্রান্ত হইয়া বাদশাহী ছাড়িয়া আজীবন এক বিধবার পদসেবা করিয়াছিলেন। বস্তুত, এই রোগের প্রকোপে এতদ্ররূপ পদস্থলনের ঘটনা প্ৰায়শ শ্রুতিগোচর হয়।
অবাক হইতে হয় যে, এই রোগের ফলে অনেকের সাড়ে সর্বনাশ হওয়া সত্ত্বেও লোকেরা ইহাকে ভালো বাসা অর্থাৎ ভালো অনুভব করা বলিয়া থাকে। রবীন্দ্রনাথ নামক একজন বাঙ্গালি কবি তাঁহার তরুণ বয়সে এই কথাটির মৃদু প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছিলেন যে, ভালোবাসা এমন যন্ত্রণাদায়ক, তাহা সত্ত্বেও লোকে কেন ইহাকে ভালোবাসা বলে! কিন্তু তাঁহার এই প্রতিবাদ আন্তরিক ছিলো বলিয়া বিশ্বাস হয় না। কারণ পরবর্তী কালে তিনি আবার “ভালোবাসা ভালোবাসা” বলিয়া গলা ফাটাইয়া এন্তার গান করিয়াছিলেন। অনেকে বলেন যে, প্রেমের পীড়ায় পিষ্ট হইয়া দারুণ ক্লের হইলেও ভিতরে ভিতরে হৃদয়ে ইহা এক প্রকার সুখের সুড়সুড়ি দিয়া থাকে। সেই কারণে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও জানিয়া-শুনিয়াও এই বিষ পান করিবার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি করেন না। বিষপান করিয়া তাহা লইয়া আবার ইনাইয়া-বিনায়াই গান করেন।
সমস্যার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি
মোদ্দা কথা, সমস্যাটি ব্যাপক এবং ভয়াবহ। তাবৎ বিশ্ব এই ব্যাধির খপ্পরে পড়িয়া আকুলি-ব্যাকুলি করিতেছে। অনেকে মাথায় হাত দিয়া হাহাকার করিতেছে। মলিন বিষন্ন মুখে ফ্যা ফ্যা করিয়া আকাশের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকাইয়া কি যেন খুজিতেছে। নৈশকালে শয্যায় ছটফট করিতেছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই রোগের কোনো কার্যকর চিকিৎসা অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া শুনি নাই। বসন্ত, ওলাউঠা, ধনুষ্টঙ্কার, এমন কি কোনো কোনো কৰ্কট রোগেরও টিকা আবিষ্কৃত হইয়াছে। কিন্তু প্ৰেমরোগ ঠেকাইয়া রাখিবার কোনো টিকা অদ্যাবধি উদ্ভাবিত হয়। নাই। মনে হয়, বৈজ্ঞানিকদের সেই রূপ টিকা আবিষ্কার করিবার সত্যিকার সদিচ্ছাও নাই। তাজ্জব হইতে হয় এই ভাবিয়া যে, কুকুর-বিড়ালের মতো ইত্যর প্রাণীর রোগ নিরাময়ের জন্য গবেষণার এক শেষ হয়, অথবা শত শত কোটি মুদ্রা ব্যয়ে পুরুষত্বহীনতার ঔষধ আবিষ্কার করিবার নিমিত্ত গবেষণা হইতেছে। কিন্তু যে-প্রেম রোগে আক্রান্ত হইয়া পুরুষত্বহীনতার বিষয়ে বীর পুরুষরা বিশেষ সচেতেন হইয়া উঠেন, খোদ সেই রোগ হইতে যাহাতে আত্মরক্ষা করিতে পারে, তাহা লইয়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয় না।
এমন কি, এই রোগের হেতু কি এবং ইহা কিভাবে বিস্তার লাভ করে তাহা লইয়াও এ যাবৎ সর্বজনস্বীকৃত কোনো মতবাদ বা থিওরি প্রচলিত নাই। ভূত তাড়াইবার, পরীক্ষা পাশের, শত্রুর ক্ষতি করিবার তাবিজ এবং মাদুলিধর্মব্যবসায়ীদের দক্ষিণা দিলে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্ৰেমরোগ আরোগ্য করিবার মতো কোনো তাবিজ অথবা মাদুলি পাওয়া যায় না। যেগুলি পাওয়া যায়, তাহা রীতিসমত উপায়ে গ্রহণ করিলেও কাহারও রোগমুক্তি হইয়াছে বলিয়া প্ৰত্যক্ষ সাক্ষ্য অথবা নির্ভরযোগ্য কোনো প্ৰমাণ পাওয়া যায় না।
এই নিদারুণ ব্যাধির অভিজ্ঞতা হইতে গৃহীদের তো কথাই নাই, মুনীঋষি এবং মহাপুরুষরাও–কেহই রেহাই পান নাই। কোনো কোনো মহাপুরুষের উপর ইহার প্রভাব বরং অধিক বলিয়া ধারণা হয়। বরঞ্চ ইহার কুফল হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করিয়া তাহারা ভালোবাসা হইতে যোজন যোজন দূরে থাকিবার উপদেশ দিয়াছেন। তাঁহারা বলিয়াছেন যে, শারীরিক প্রয়োজন হইলে সারিয়া ফেলো। অর্থাৎ পুত্রার্থে সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়া বাঞ্ছনীয়। (আধুনিক নারীবাদীরা রাগ করিবেন না; কিন্তু মনু মহাশ পুত্রার্থেই লিখিয়াছেন, কন্যার্থে লেখেন নাই–আমার অপরাধ লইবেন না।) তাহারা এই কথাও বলিয়াছেন যে, বিবাহ না-করিলে পাতক হইতে হইবে। যাহারা সন্তান উৎপাদনের বিষয়ে আগ্রহ প্ৰদৰ্শন করেন না, বিধানদাতাদের মতে, তাহারা অতিশয় নিন্দনীয়। কেবল মনু মহাশয় নহেন, বস্তুত সকল ধর্মপ্রবর্তকই এইরূপ দৈহিক প্রক্রিয়ার বহির্ভূত কোনো মানসিক বিকারের–অর্থাৎ প্রেমের— অকুণ্ঠ নিন্দা জ্ঞাপন করিয়াছেন। অধিক ফসল উৎপাদনের জন্য যেমন অধিক জমির প্রয়োজন, তেমনি অধিক সংখ্যক সন্তান জন্মদানের জন্যে অনেকগুলি গৰ্ভ সংগ্ৰহ করিবার ব্যাপারেও ধর্ম উদারভাবে অনুমতি দিয়াছে। কিন্তু প্ৰেম? তওবা! সাফ দিলের উপর এসব হইল। শয়তানের আছর। (কোনো কোনো ধর্মে বিবাহের সর্বোচ্চ সংখ্যা বঁধিয়া দেওয়া হইয়াছে। আবার, কোনো কোনো ধর্ম এতো উদার যে, সংখ্যা নির্ধারিত করিয়া বিবাহের মতো মহৎ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হানি করে নাই। বরং কোনো কোনো ধর্মে অর্থ এবং দৈহিক সামর্থ্য থাকিলে যতগুলি ইচ্ছা ক্রীতদাসী সংগ্ৰহ করিয়াও বিনোদনের ব্যবস্থা জোরদার করিবার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু প্ৰেমরোগ হইতে সর্বদা দূরে থাকার কথা শাস্ত্রে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে কথিত হইয়াছে।)
অনেকের ধারণা, পুরুষরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়েন। কিন্তু তাহারা কোন আক্কেলে এই উক্তি করেন, বোঝা যায় না। কারণ, কলিকালে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হইয়া প্রায়শ বিশেষ কাবু হয়েন বলিয়া শোনা যায়। এমন কি, তাহাদের মধ্যে যাহারা এই রোগের প্রকোপে হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া ফেলেন, তাহারা আর কিছু না-পাইলে তাঁহাদের বস্ত্ৰ বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে কণ্ঠে প্যাঁচাইয়া আত্মহত্যা পর্যন্ত করিয়া থাকেন। কিন্তু শাস্ত্রাদেশ মানিয়া নারীরা গৃহপালিত জন্তুদের মতো গৃহাভ্যন্তরে বন্দী থাকিলে এই অনাহূত ঝামেলা হইতে অনায়াসে আত্মরক্ষা করিতে পারিতেন। (অসূৰ্যাম্পশ্যাদের এই সব উৎপাত ছিলো না। কিন্তু সেই সুখের সত্যযুগ বহু কাল বিগত হইয়াছে।) মোট কথা, ধর্মে লিঙ্গভেদের প্রতি প্রবল জোর দেওয়া হইলেও এই রোগ লিঙ্গভেদ করে না। এই রোগ সার্বজনিক।