দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত চাকরির। সেকালের ইংল্যান্ডে চাকরির ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্যে বৈষম্য বেশি ছিলো বললে, কিছুই বলা হয় না। বলা উচিত, তাদের চাকরি করার অধিকার সামান্যই ছিলো। তাঁদের জন্যে বরাদ্দ ছিলো কতোগুলো বিশেষ ধরনের চাকরি। যেমন, শিক্ষকতা, নার্সিং, চিকিৎসা, সেলাইয়ের কাজ ইত্যাদি। সব চাকরির জন্যে তাদের যোগ্য বলে গণ্য করা হতো না। আর, ভারতবর্ষে মেয়েদের চাকরি করার ধারণা ছিলো রীতিমতো সমাজকে অগ্রাহ্য করার মতো। এমন কি, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও যামিনী সেনের মতো যারা ডাক্তার হয়েছিলেন, অথবা কামিনী সেন ও চন্দ্ৰমুখী বসুর মতো যারা শিক্ষকতায় এগিয়ে এসেছিলেন, তারা সমাজে নিন্দিত হয়েছিলেন। তাঁদের সহজে বিয়ে হয়নি। চাকরি-করা মেয়েদের কারো কারো আবার আদৌ বিয়েই হয়নি–যেমন, রাধারানী লাহিড়ী এবং যামিনী সেনের। রাধারানী ছিলেন শিক্ষক, আর যামিনী ছিলেন ডাক্তার।
এই পরিবেশে রোকেয়া লিখেছিলেন, এমন কোনো কােজ নেই, যা মেয়েদের করা উচিত না। কেরানি থেকে ভাইসরয় পর্যন্ত সব কাজই তারা করতে পারেন। যোগ্যতা থাকলে। এমন কি, তারা ব্যবসা করতে পারেন, অথবা পারেন মাঠে গিয়ে কৃষিকাজ করতে। তিনি আরও লিখেছেন, মেয়েরা অর্থনৈতিক কাজ করে যতোই স্বাবলম্বী হবেন, পুরুষদের আধিপত্য থেকে ততোই রক্ষা পাবেন। পুরুষরা নারীদের শোষণ এবং নির্যাতন করার সুযোগ পান বেঁচে থাকার জন্যে নারীদের যেহেতু তাদের ওপরই নির্ভর করতে হয়।
কেবল চাকরি নয়, রোকেয়া সব ব্যাপারেই পুরুষদের সমকক্ষতা দাবি করেছেন। তিনি লিখেছেন, “… আমরা যে গোলামের জাতি নই, এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।” অন্যত্র বলেছেন, নারীও মানুষ। “বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব। নই; বল কন্যে! জড়াউ অলঙ্কার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ।” তিনি আরও লিখেছেন যে, নারী এবং পুরুষ দুজন সমান না-হলে সমাজ এবং সংসারের যথার্থ উন্নতি হতে পারে না। চমৎকার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, গাড়ির দুচাকা সমান না-হলে সে সামনে যেতে পারে না। শিক্ষার অভাবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যে পরিপূর্ণতা লাভ করে না–সে কথাও তিনি লিখেছেন। “স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন।” এটা সুখী অথবা আদর্শ দাম্পত্যের দৃষ্টান্ত নয়।
আধুনিক নারীবাদীরা আর-একটা বিষয়ে সচেতন হয়েছেন–সে হলো: নারীদের বন্দিত্ত্বে ধর্মের ভূমিকা। কিন্তু ১৯০৪ সালে এ কথা বাঙালি কেন, কোনো বিদেশীও লেখেননি। তা সত্ত্বেও, পর্দানশিন রোকেয়া সেই সময়ে লিখেছিলেন:
“…কোনো ভগ্নি মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্ৰঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ এই ধর্মগ্রন্থগুলি ঈশ্বরের আদেশ বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। … এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন।”
অন্যত্র লিখেছেন: “যেখানে ধৰ্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্ৰায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।” এই উক্তির সত্যতা সে যুগে তো দূরের কথা, এ যুগেও বুঝতে পারেন, এমন নারীপুরুষের সংখ্যা বেশি নেই। এ উক্তি সম্পর্কে আরও একটা কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে বলা উচিত: রোকেয়া এ কথা লিখে যো-সৎসাহসের পরিচয় দেন, তা তুলনাহীন। সম্ভবত এ যুগের মৌলবাদী পরিবেশে এ কথা লিখতে তিনি সাহস পেতেন না।
সুলতানার স্বপ্ন নিতান্তই কল্পনা। এতে তিনি লিখেছিলেন এক কল্পিত নারীস্থানের কথা— যে-দেশে নারী ও পুরুষের ভূমিকা উল্টে দেওয়া হয়েছে। দেশ শাসন থেকে শুরু করে বাইরের কাজগুলো করেন নারীরা। আর পুরুষরা করেন ঘরের কাজ। এই গল্পে রান্নাবান্না থেকে আরম্ভ করে যুদ্ধ করার কাজেও সৌরশক্তি ব্যবহারের কথা লিখেছেন তিনি। উভয় চিন্তাতেই তাঁর দূরদৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে। সত্যিই, এখন তো নারীরা যুদ্ধ করা থেকে আরম্ভ করে সবই করছেন। পুরুষরা ঘরের কাজে অংশ নিতে শুরু করেছেন। এবং সৌরশক্তির অসাধারণ সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে। কোনো পুরুষ তো সেকালে এ ধরনের কথা লেখেননি!
এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাঁকে সত্যি সত্যি সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর মনে হয়। মনে হয়, তিনি জন্মেছিলেন সময়ের তুলনায় অনেক আগে। সে জন্যেই একদিকে তিনি যেমন তাঁর নিজের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি; অন্য দিকে আবার তার বক্তব্য দিয়ে সমাজের পক্ষে যতোটা প্রভাবিত হওয়ার কথা ছিলো, তাও হয়নি। আরও আশ্চর্য লাগে যে, তিনি যেসব বৈপ্লবিক কথাবার্তা লিখেছিলেন, তা যেন কারও চোখেই পড়েনি। ভাগ্য এবং সময় তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করেছিলো। একে তিনি নারী, তার ওপর তিনি মুসলমান। তখনকার ভাবুক এবং সাহিত্যিকদের তাই তাঁর লেখা চোখে পড়েনি। শুনেছি, রবীন্দ্রনাথ জানা-অজানা অনেকের লেখাই পড়তেন এবং নিজের থেকেই তাদের উৎসাহ দিতেন। কিন্তু রোকেয়া নামটি তারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। অথবা করলেও, তিনি তাঁর মতামত হয়তো সমর্থন করতেন না। রোকেয়া যখন তাঁর প্রথম গ্ৰন্থ প্রকাশ করেন, মোটামুটি সে সময়েই পীরালি পাত্ৰ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ সাড়ে দশ বছরের কন্যাকে তাঁর ইচ্ছা! যাচাই না-করেই বিয়ে দিয়েছিলেন। সে যুগে বড়ো কোনো মুসলমান সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু যারা ছিলেন, তারা কেউ রোকেয়ার লেখা পড়ে কোনো অনুকুলপ্রতিকূল মন্তব্য করেননি। প্রভাবিত হওয়া তো দূরের কথা! এমন কি, নজরুল ইসলামও “নারী’র মতো একটি বিখ্যাত কবিতা লিখলেও রোকেয়া সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখেছেন বলে শুনিনি।