তাঁকে বিয়ে করতে হয়েছিলো দোজবর–সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনকে। রোকেয়ার যদি ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে থাকে, তা হলে তখন তার স্বামীর বয়স ছিলো চল্লিশ অথবা একচল্লিশ বছর। এই স্বামীর আগের পক্ষের এক প্ৰাপ্তবয়স্ক সন্তান ছিলো। সে সন্তান পরে বিমাতাকে যথেষ্ট জ্বলিয়েছিলেন। তা ছাড়া, স্বামীর ছিলো বহুমূত্র রোগ। স্বামী মারাও যান চাকরিজীবন শেষ করার আগেই। এই স্বামীর সঙ্গে মহা আনন্দে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন শুরু হয়েছিলো বলে মনে হয় না। কিন্তু, আমার ধারণা, এই স্বামীই রোকেয়ার চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছিলেন এবং তাঁর সুপ্ত প্রতিভাকে উস্কে দিয়েছিলেন।
মৌখিক ছাড়া সাখাওয়াত বাংলা ভাষা ভালো জানতেন না। তাই রোকেয়াকে বাংলা শিখতে তিনি সাহায্য করতে পারেননি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তার কাছ থেকেই রোকেয়া লেখাপড়া শেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন। আর ইংরেজি যে তিনি তারই যত্নে শিখেছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার চিঠিপত্র থেকে দেখা যায় যে, ইংরেজি তিনি ভালোই শিখেছিলেন। ইংরেজি ভাষা ছাড়া, ফেমিনিজমের কথাও তিনি যদি বিলেত-ফেরত স্বামীর কাছ থেকে শুনে থাকেন, তা হলে অবাক হবো না। শুনে থাকা কেন, আমার বিশ্বাস, এ সম্পর্কে রোকেয়া তার কাছ থেকে রীতিমতো সবক নিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয়, সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০-র দশকের গোড়ার দিকে কৃষি বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্যে বিলেত যান। সম্ভবত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন যান, সেই সময়েই গিয়েছিলেন। বিলেতে তখন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নারীকর্মীরা রীতিমতো টগবগা করছিলেন। সাখাওয়াত সেই আন্দোলন কেবল প্রত্যক্ষ করেননি। ধারণা করি, নীতিগতভাবে তাকে স্বাগতও জানিয়েছিলেন।
ইংলণ্ড বঙ্গমহিলা (১৮৮৫) গ্রন্থের লেখিকা কৃষ্ণভাবিনী দাসও তখন লন্ডনে ছিলেন। তিনিও সেই আন্দোলন কাছ থেকে লক্ষ্য করেছিলেন এবং দেশে ফিরে এসে সে সম্পর্কে লিখেছিলেন। রোকেয়ার পক্ষে, তাঁর সেই লেখা পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো: রোকেয়াকে ইংরেজি শিখিয়ে এবং ইংরেজি পড়তে উৎসাহ দিয়ে সাখাওয়াত জ্ঞানের সদর দরজাটা খুলে দিয়েছিলেন। নারীবাদী লেখিকা মেরী করেলির রচনা থেকে আরম্ভ করে ইংরেজি অনেক রচনাই রোকেয়াকে অনুপ্রাণিত করেছিলো। ইংরেজির মাধ্যমেই তিনি সুলতানার স্বপ্লের ধারণা লাভ করেছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, তাঁর চিন্তাধারাই ছিলো মৌলিক, যুক্তিবাদী এবং আধুনিক। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবােধকে তিনি চােখ বুজে। স্বীকার করে নিতে পারেননি।
তাঁর চিন্তাধারা আধুনিক–এ কথা বললে আসলে যথেষ্ট বলা হয় না। তার কারণ তিনি যেসব কথা লিখেছেন, তা লিখেছিলেন ফেমিনিজমের একেবারে আদি যুগে। তখনও পাশ্চাত্যেই ফেমিনিজম কী–সেই ধারণা যথেষ্ট পরিষ্কার হয়নি। তাই রোকেয়ার অবদানকে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, প্রকৃতপক্ষে, তার অবদান তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা দরকার, ফেমিনিজম শব্দটা প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয় ১৮৩৭ সালে। আর, কয়েকজন মার্কিন মহিলা একত্রিত হয়ে প্রথমবারের মতো নারীবাদী দাবি উত্থাপন করেন ১৮৪৮ সালে, নিউ ইয়র্ক শহরে। ইংল্যান্ডে এ নিয়ে আন্দোলন শুরু হয় আরও পরে–১৮৬০-এর দশক থেকে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ১৮৭০-এর দশকে বছর তিনেক ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে ছিলেন। বামবোধিনী পত্রিকায় তিনি একাধিক রচনা প্ৰকাশও করেছিলেন। কিন্তু তিনি নারীবাদী আন্দোলনের কথা লেখেননি। ভারতবর্ষে এ সম্পর্কে কৃষ্ণভাবিনীই প্রথম উল্লেখ করেন। অবশ্য এখানে বলা দরকার যে, নারীরা বন্দী–এই কথা বলে কৃষ্ণভাবিনী দুঃখ করলেও, নারীদের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির কথা তিনি বলেননি। অর্থাৎ নারীদের অবস্থা উন্নতির কথা বললেও, নারীবাদী অধিকারের কথা তাঁর রচনায় নেই। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি যে-ধরনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তার মধ্য দিয়েও তার নারীবাদী মনোভাব প্রকাশ পায় না। অপর পক্ষে, নারী আন্দােনের সেই প্রত্যুষেই রোকেয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে কেবল নারীদের উন্নতির কথা বলেননি, বরং নারীবাদের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। বস্তৃত, কৃষ্ণভাবিনীর তুলনায় তিনি ছিলেন অনেক অগ্রসর এবং বলা যেতে পারে যে, বাঙালি নারীদের মধ্যে তিনিই প্ৰথম সত্যিকারের নারীবাদী।
এখানে নারীবাদের একটা ছোট্টো সংজ্ঞা দিয়ে নিই, যাতে ভুল বোঝাবুঝি নাহয়। নারীদের উন্নতির কথা বললেই নারীবাদ বোঝায় না। নারীবাদ একটা মতবাদ। নারীরা পুরুষদের হাতে নির্যাতিত একটি শ্রেণী— এই মতবাদকে এক কথায় বলা যায় নারীবাদ। যারা নারীবাদী তারা নিজেরা সেই নির্যাতিত শ্রেণীর সদস্য বলে নিজেদের শনাক্ত করেন।
নারীবাদীরা কেবল নারীদের অবস্থার যৎকিঞ্চিৎ উন্নতি চান না। তাঁরা মনে করেন নারী আর পুরুষ একেবারে সমান। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সমান। অধিকার পেতে পারেন–শিক্ষায়, পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে, ঘরের কাজে, সন্তান লালনে, সামাজিক মর্যাদায়, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে, চাকরির ক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, ধমীয় আচার-অনুষ্ঠানে। কিন্তু কেবল ভারতবর্ষে নয়, তখনকার ইংল্যান্ডেও এই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বড়ো দুটো দৃষ্টান্ত দিয়ে এটা বােঝানো যায়। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্ৰযুক্তি, সাহিত্য-সঙ্গীতে ইংল্যান্ড উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিলো। কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে এ উন্নতি সীমাবদ্ধ ছিলো পুরুষদের মধ্যে। ১৯২০-এর দশকের আগে পর্যন্ত অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ মেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার সাধারণ অধিকার পর্যন্ত দেয়নি। অপর পক্ষে, ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আংশিকভাবে সে অধিকার দিয়েছিলো, যদিও বাস্তবে তা সীমাবদ্ধ ছিলো গুটিকতক ব্ৰাহ্ম এবং খৃস্টানের মধ্যে। মুসলমান নারীদের পড়ার অধিকার পর্যন্ত ছিলো না। সরকারী বিদ্যালয়–বেথুন স্কুল অথবা বেথুন কলেজে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশব সেনের মতো সমাজসংস্কারকও মেয়েদের নিতান্ত সাধারণ শিক্ষা দানের পক্ষপাতী ছিলেন; উচ্চশিক্ষার নিন। তাঁরা মনে করতেন, পুরুষালি শিক্ষা, যেমন, গণিত এবং বিজ্ঞান, মেয়েদের কমনীয়তা নষ্ট করবে।