বাঙালি অথবা পশ্চিমা মহিলাদের সঙ্গেও আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করেছি, কী তাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ–অর্থাৎ পারিবারিক জীবনের বাইরে। তাতে আমার মনে হয়েছে, পরিবারে স্বামী, সন্তান এবং স্বামীর ও নিজের তরফের আত্মীয়দের নিয়ে যেপরিধি রচিত হয়, তার মধ্যে থেকেই তারা ঠিক সুখী হন না। বরং তার বাইরে চাকরি সূত্রে তাদের যে একটা পরিচিতি এবং বন্ধুত্বের মহল তৈরি হয়, সেখানে তাঁরা জীবনের সফলতা খোঁজেন। সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ কিছু করতে পারলে তৃপ্তি পান। অপর পক্ষে, সেখানে ব্যর্থ হলে বিষাদ নেমে আসে।
সামাজিক পরিবর্তনের ফলে মহিলাদের ভাবমূর্তিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আগে প্রকাশ্য সমাজে মহিলা বলতে বোঝাতো গুরুগম্ভীর, বোবার মতো একজন মানুষ; কিন্তু নারীমুক্তির ধারণা এসে তাঁদের কথা বলার, তর্ক করার এবং বক্তব্য রাখার অধিকার দিলো। তাঁরা আর চুপ করে থাকলেন না। তাঁরা রসিকতা করতে আরম্ভ করলেন। এমন কি, এ রকমের রসিকতা, যা আগে পুরুষের একচেটিয়া ছিলো। তাঁরা প্রকাশ্যে খিলখিল করে হাসতে শুরু করলেন, যেটাকে আগে মেয়েদের জন্যে অভব্যতা বা অশিষ্ট বলে মনে করা হতো। এখনো এ ধারণা যে একেবারে চলে গেছে, তা নয়। কদিন আগেও রিপা নামে আমার এক পাঠিকা। আমাকে লিখেছেন যে, তিনি জোরে হাসায় তাঁর বড়োকর্তা–ব্যাংকের ম্যানেজার–এসে তাঁকে শাসন করেন।
সমাজে যখন নারীদের জায়গাটা প্রশস্ত হলো, তখন পোশাকের দিকেও তারা মজর দিলেন। এমন কি, নিজের শরীরে যেসব সৌন্দর্যের বস্তু আছে, তাও অল্পবিস্তর প্ৰকাশ করতে আরম্ভ করেন। কারণ, তা দিয়ে তারা সমাজের আর-পাঁচজন মানুষমারী ও পুরুষ–উভয়কেই মুগ্ধ করতে চেষ্টা করেন। কোনো একটা পোশাক পরে অফিসে অথবা পার্টিতে গেলে যদি স্মার্ট লাগে, সুন্দর লাগে, তা হলে সে পোশাক তারা কেন পরবেন না? কেন তা দিয়ে অন্যের চোখে নিজের একটি প্রভাব বিস্তার করার মতো ভাবমূর্তি গড়ে তুলবেন না?
পশ্চিমা দেশগুলোতে এখন নারীর সমান অধিকার কমবেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা নারীদের নির্যাতিত একটি শ্রেণী হিশেবে দেখতেন এবং সেই শ্রেণীর সদস্য হিশেবে নিজেদের শনাক্ত করতেন, অর্থাৎ নিজেদের নারীবাদী হিশেবে চিহ্নিত করতেন, তারা যে তাই বলে সুখী হয়েছেন, তা মনে করার অবশ্য কারণ নেই। কারণ, বৈষম্য দূর হলে অথবা সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেই সুখ আসে না। সুখ একটা মানসিক অবস্থা। সে জন্যে নারীবাদীরা এখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, অতঃপর কী? অধিকার, প্রতিষ্ঠা, জীবনের সাফল্য, পুরুষের সমান হওয়ার বাসনা–সবই দরকার; কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে: জীবনে সুখী হচ্ছি। তো? অনেক লড়াইয়ের পর পোস্ট-ফেমিনিস্টরা এখন কী পাইনি তার হিশাব মিলাতে ব্যস্ত। কিন্তু, তওবা, অন্তত ফের তারা পুরুষের পদতলে বেহেস্ত খুঁজবেন না!
(যুগান্তর, জানুয়ারি ২০০৫)
০৩. রোকেয়া : অবদান ও সীমানা
ঠাকুর পরিবারের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী, পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী অথবা দৌহিত্রী সরলা দেবী কী করে শিক্ষিত এবং আধুনিক হলেন, তা খানিকটা আঁচ করা যায়। কিন্তু লেখাপড়ায় পিছিয়ে-থাকা একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের কন্যা রোকেয়া* কী করে শিক্ষিত এবং, তার চেয়েও বড়ো কথা, নারীবাদী হলেন, তার কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। বরং অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভব মনে হয় একে। তিনি এমন এক পরিবারে জন্মেছিলেন, যেখানে কেবল পুরুষদের সামনে নয়, পাঁচ বছর বয়স থেকে তাকে অপরিচিত মহিলাদের সামনেও পর্দা পালন করতে হতো। সে পরিবারে মেয়েদের শিক্ষা নেওয়া, বিশেষ করে বাংলা অথবা ইংরেজি–তা-ও নিষিদ্ধ ছিলো। স্কুলে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আর, মুসলমান মেয়েদের পড়ার কোনো স্কুলও ছিলো না তখন। এই পরিবেশে বড়ো বোন করিমুন্নেসার কাছ থেকে রোকেয়া খানিকটা বাংলা শিখেছিলেন এবং বড়ো ভাই ইবরাহিম সাবের তাকে লেখাপড়া করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। বোধ হয় ইংরেজরি অআকখও শিখিয়েছিলেন। কিন্তু এ রকম শিক্ষা এবং উৎসাহ উনিশ শতকে অনেকেই পেয়েছিলেন। তারা কেউ রোকেয়া হয়নি।
রোকেয়া লিখতে আরম্ভ করেন বিশ শতকের একেবারে শুরুতে–১৯০৩ সাল থেকে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ মতিচুর। এ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৩১১ সালে। দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩১৪ সালে। এই বইয়ের একাধিক প্রবন্ধে তিনি নারীমুক্তি এবং নারীদের সামাজিক উন্নতির কথা বলেন। নিজের জীবনে তিনি পর্দার নিপীড়ন এবং নারীদের নির্যাতন লক্ষ্য করেছিলেন। বহুবিবাহের কুপ্ৰথা দেখার জন্যে তাঁকে আদৌ দূরে দৃষ্টি দিতে হয়নি। তাঁর পিতা সম্ভবত চারবার বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন। এক আইরিশ নারী। সিপাহী বিপ্লবের সময়ে আশ্রয় দিয়ে ঐকে অস্থায়ী স্ত্রী করে নিয়েছিলেন। অস্থায়ী বলছি এ জন্যে যে, এ বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। সমাজের দিকে ৩াকিয়েও রোকেয়া সেখানে দেখেছিলেন। অবরোধের নিপীড়ন এবং অশিক্ষার অন্ধকার। এসব তাঁকে নারীমুক্তি সম্পর্কে সচেতন করে থাকবে। কিন্তু সেকালের অভিজাত পরিবারের অন্য নারীরাও কমবেশি একই পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন। ওঁরা রোকেয়ার মতো সচেতন অথবা সোচ্চার হননি। আমার ধারণা, তার ভেতরেই fগুলো প্রতিভার দীপ্তি। প্রতিবাদের শিখা। স্বামীর সান্নিধ্যে সেই প্রতিভা ফুটে উঠেছিলো। সেই শিখা আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিলো। কিন্তু তাঁর বিয়েটাকে কেউই আপাতদৃষ্টিতে ঠিক আদর্শ বলে মনে করবেন না— একালে তো নয়ই, এমন কি, সেকালেও করার কথা না।