জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া, পিলের সঙ্গে নারীমুক্তির ইতিহাসের আর-একটা যোগাযোগ ঘটলো পিল বাজারে ছাড়া পাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে। আমার ধারণা, সেই অসাধারণ ঘটনার কথা না-বললে নারীমুক্তির ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক অকথিত থেকে যায়। সন্তানের সংখ্যা সীমিত রাখার সুযোগ পেয়ে যৌনতার একটা ফলাফল থেকে মহিলারা বেঁচে গেলেন। কিন্তু তা দিয়ে তাদের সমস্ত অধিকার আদায় হলো না। মহিলারা যৌনতা কতোটা উপভোগ করেন, কতোটা উপভোগ করতে চান, পুরুষ সে প্রত্যাশা কতোটা পূরণ করেন–এসব তখনো অজানা ছিলো। আন্দাজঅনুমানের ওপর ভিত্তি করেই নারী এবং পুরুষ গবেষকরা এসব নিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু বিবাহিত না হয়েও যে মহিলারা যৌনসুখ প্রত্যাশী হতে পারেন, তা পরিষ্কার হয়ে গেলো। কয়েক বছরের মধ্যে। ১৯৬২ সালে প্ৰকাশিত “সেক্স এবং দ্য সিঙ্গল গ্যার্ল” নামে একটি বই বিক্রয় তালিকার শীর্ষে চলে গেলো। কয়েক বছরের মধ্যে অবিবাহিত মেয়েদের যৌনতা নিয়ে আরও কয়েকটি বই এবং কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু একেবারে নতুন দিগন্ত খুলে গেলো। ১৯৬৬ সালে–মাস্টার্স এবং জনসনের বই প্ৰকাশিত হওয়ার পরে।
উইলিয়াম মাস্টার্স এবং ভ্যার্জিনিয়া জনসন এগিয়ে এসেছিলেন মধ্যবিত্ত নারীদের যৌনতা সম্পর্কে গবেষণা করার জন্যে। এরা ৬৯৪ জন পুরুষ এবং মহিলার চরম যৌনসুখ সম্পর্কে গবেষণা করেন। এবং সেই গবেষণার ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালে তাঁরা “হিউম্যান সেন্ধুয়াল রেসপন্স” নামে একটি বই লেখেন। তাতে পুরুষদের যৌনতা সম্পর্কে পিলে চমকে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য ছিলো না, কিন্তু ছিলো মেয়েদের যৌনতা সম্পর্কে। বিশেষ করে তাদের যৌনজীবনের অপূর্ণতা এবং হতাশা সম্পর্কে। তাতে দেখা যায় যে, মেয়েরা পুরুষদের মতোই যৌন আনন্দ উপভোগ করতে সমর্থ এবং আগ্রহী। তবে পুরুষরা স্বার্থপরতার কারণে তাদের স্ত্রী অথবা মেয়েবন্ধুর যৌনজীবনের পরিপূর্ণতার খবর রাখেন না। অথবা তাঁদের হতাশা থাকলে তা দূর করার কোনো সক্রিয় প্ৰযত্ন করেন না। এই জন্যে এই গবেষকরা উপদেশ দেন যে, তাদের নারীসঙ্গিনীর যৌনতৃপ্তি দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ কমানোর জন্যে পুরুষদের আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। এই গ্ৰন্থ যে মহিলাদের যৌনতা সম্পর্কে বহু নিষিদ্ধ ধারণাকে বরবাদ করেছিলো, এ সম্পর্কে সন্দেহ নেই। এবং অনেকটা এর ফল হিশেবে মহিলারা বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে থেকেও নানা উপায়ে অথবা বিবাহ বহির্ভূত নানা সম্পর্কের মাধ্যমে যৌনসুখ পাওয়ার ব্যাপারে আগের তুলনায় বেশি আগ্রহী এবং উৎসাহী হন। লেজবিয়ান সম্পর্কও এ সময়ে জোরদার হতে থাকে।
একবার মাস্টার্স এবং জনসনের বই প্ৰকাশিত হওয়ার পর এ ব্যাপারে বই লেখার অথবা যৌনসুখ বাড়ানোর উপায় নিয়ে বই লেখার আরও কোনো বাধা থাকলো না। ১৯৭১ সালে ডেইভিড রুবেন লেখেন “অ্যানি উম্যান ক্যান” এবং তার চেয়েও মূল্যবান এবং সচিত্র বই অ্যালেক্স কমফটের “দ্য জয় অব সেক্স” (১৯৭২) এবং “মোর জয় অব সেক্স” (১৯৭৪)। সত্যি বলতে কি, মাস্টাস অ্যান্ড জনসনের-এর গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর আরও বহু গবেষণা হয়েছে এবং তার ফলাফল প্ৰকাশিত হয়েছে। তা থেকে দেখা যায় যে, প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ মহিলা কোনো সময়ই চরম সুখ পান না। চরম সুখ পাওয়ার জন্যে যে-শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা দরকার, তাদের তা নেই। ব্যাপারটা কি, তা-ই তারা জানেন না। অপর পক্ষে, যারা চরম সুখ পেতে শারীরিকভাবে সক্ষম, তেমন মেয়েরাও বেশির ভাগই সময়ই পুরুষ-শরিকের নিস্ক্রিয়তার ফলে চরম সুখ লাভ করেন না। তাঁরা যে চরম সুখের খোজে বিবাহবহির্ভূত নানা রকম সম্পর্ক গড়ে তুললেন, তাকে অনেক পুরুষ, এমন কি, অনেক সনাতনপন্থী মহিলাও এক কথাতেই অ-সতীত্ব বলে মার্কা মেরে দিলেন। অর্থাৎ বহু শতাব্দীর বঞ্চনা এবং প্রবঞ্চনাকে এতো দিন সতীত্বের নামে গৌরবারোপিত করে ঢেকে রাখা হয়েছিলো, কিন্তু পিল এসে সতীত্বের সেই কিংবদন্তীকে ভেঙে দিলো।
অথচ তত্ত্বত এটা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, অন্য পাঁচজন মানুষের অর্থাৎ পুরুষ মানুষের মতো মেয়েদেরও যৌনজীবনের পরিপূর্ণতা লাভের সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এবং সে অধিকার পূরণ না-হলে মানুষ হিশেবে সে নারীর জীবনে পূর্ণতা আসতে পারে না, স্বাধীনতা লাভ দূরে থাক। মহিলাদের মুক্তির এই দিকটা উন্মুক্ত করে দিয়েছে পিল। পূরবী বসু পিলের অন্য দিকটা নিয়ে বললেও নারীমুক্তির একটা বড়ো দিকে তার ভূমিকা কী, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেননি।
প্রসঙ্গত নারীমুক্তির আরও কয়েকটি দিক সম্পর্কে বলা দরকার। কারণ এ সম্পর্কে আমাদের দেশের সর্বশক্তিমান পুরুষদের ধারণা তো ভ্ৰান্ত বটেই, এমন কি, শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত মহিলাদের ধারণাও ভ্ৰান্ত। বেশির ভাগ লোকই মনে করেন যে, নারী স্বাধীনতার মানে হলো নারীদের শিক্ষা, চার দেওয়ালের বাইরে যাওয়ার অধিকার, এবং পরিবারের মধ্যে খানিকটা অধিকার লাভ, বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে অধিকার। কিন্তু এইটুকু নিয়েই কি একজন নারী তাঁর জীবনের পরিপূর্ণতা অনুভব করতে পারেন?
সমস্যাটা মেয়েদের নিজেদের লেখা থেকে আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। প্রথমে পড়ি চীনা মহিলাদের লেখা একটি বই। এতে তাঁরা লিখেছিলেন যে, গৃহবধূ। হিশেবে বেঁচে থাকার ব্যাপারেই তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিরক্তি ধরে গিয়েছিলো তাদের জীবনেই। তারা তাই মনে করলেন, তারা এমন একটা কিছু করবেন যা থেকে সন্তোষ এবং পরিপূর্ণতার স্বাদ পেতে পারবেন। এ জন্যে তাঁরা দশ পনেরোজন মিলে একটি ছোটো কারখানা করলেন। সেখানে ছোটো ছোটো খেলনা তৈরি করতে আরম্ভ করেন তারা। তাদের এই প্ৰয়াস দু’দিক থেকে সফল হয়একদিকে, এ থেকে তাঁরা টাকা পয়সা উপার্জন করার সুযোগ পান, কিন্তু তার চেয়েও বড়ো একটা আনন্দ পান এই ভেবে যে, বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে তাঁরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অর্থাৎ তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী নারীর জীবনের পরিপূর্ণতা লাভের জন্যে তাঁদের রীতিমতো সমাজ এবং অর্থনীতিতে একটা অর্থবহ। ভূমিকা রাখতে হবে। নারী-জীবনের সাফল্যের অন্যান্য দিকের মধ্যে আছে পুরুষদের সমান অধিকার লাভ, ব্যবস্থাপনার কাজে অধিকার, নেতৃত্ব দানের অধিকার। এবং তারা যে যে-কোনো পুরুষের সমান মেধার অধিকারী এবং যে-কোনো কাজ করার মতো ক্ষমতার অধিকারী–এই ধারণাও তারা প্ৰতিষ্ঠা করতে চান।