অধিকার সম্পর্কে অনেক মহিলা সচেতন হয়েছিলেন উনিশ শতক থেকেই। তাদের সংখ্যাও বাড়ছিলো। অবশ্য পরিবেশ অনুকূল না-থাকায় লড়াইতে তাঁরা তেমন জুত করতে পারেননি। লেখাপড়া করতে গেলেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পরীক্ষা দেওয়ার অধিকার দিলো না। (অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ এই অধিকার দেয় ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে।) মেয়েরা সম্পত্তিতে অধিকার চাইলেন, কিন্তু ১৮৮৫ সালের আগে ব্রিটেনে তার কোনো স্বীকৃতিই ছিলো না। তাদের সেই অধিকার ধাপে ধাপে স্বীকৃত হয় এক শো বছর ধরে। এখন বিয়ে না-করে আপনি কোনো মেয়ের সঙ্গে ছ। মাসের বেশি একত্রে বাস করলে তিনি আপনার সম্পত্তিতে অধিকার দাবি করতে পারেন! মেয়েরা ভোটাধিকার চাইলেন, কিন্তু পঞ্চাশ বছরের চেষ্টাতেও তা পেলেন না। (আর কোনো কোনো আরব দেশ এখনো সে অধিকার দেয় নি!!)
মেয়েদের ঠেকিয়ে রাখার নানা উপায় ছিলো। সবচেয়ে বড়ো উপায় ছিলো সামাজিক এবং রাষ্ট্ৰীয় কাঠামোয়। সেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিলো পুরোপুরি পুরুষদের হাতে। তা ছাড়া, মেয়েদের অত্যাচার বলছিনে, কিন্তু দমিয়ে রাখার আরও উপায় ছিলো। তাঁদের গর্ভবতী করে দিতে পারলে দুতিন বছরের জন্যে বেশ নিশ্চিন্ত থাকা যেতো। গৰ্ভবতী হওয়াও ছিলো খুব সহজ। জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় ছিলো মা–কনডম ছিলো না, অপারেশান ছিলো না, পিল ছিলো না, গর্ভপাতের ব্যবস্থাও ঙিলো অপ্রতুল। সুতরাং তাদের ওপর কয়েকবার চেপে বসতে পারলেই গর্ভ হতো। এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের মায়ের চোদ্দোটি সন্তান হয়েছিলো। তা-ও দেবেন্দ্রনাথ বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকতেন না। এমন চোদ্দো সন্তানের জননীর শ্বাস ফেলার সময় আছে! অথবা স্বাধীনতা কী বস্তু, তা ভাববার!
এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে পরিবারের ভেতরে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করা ছিলো একেবারে অত্যাবশ্যক। এই উন্নতির একটা অংশ ছিলো সন্তানদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। তাই গৰ্ভ ঠেকিয়ে রাখার উপায় নিয়ে তারা গবেষণা করতে থাকেন। একটা সনাতন উপায় তো ছিলোই! গৰ্ভপাত ঘটানো। (অবাঞ্ছিত গৰ্ভ হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ জন্যে মেয়েদের খুনও করা হতো!), কিন্তু উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে কিভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে, নিরাপদে গর্ভপাত করা যায়, তার ব্যবস্থা হতে থাকে। এমন কি, একজন দুঃসাহসী মহিলা লন্ডনে গর্ভপাত করার একটা ক্লিনিকও খুলে বসলেন সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে। কিন্তু সমাজের বিরোধিতার মুখে সেখানে সহজে সাফল্য আসতে পারেনি। ধর্মীয় চাপও কম প্ৰবল ছিলো না। এখনো ক্যাথলিক দেশ আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত করা নিষিদ্ধ। কয়েক বছর আগে একটি পনেরো বছরের মেয়েকে তার বাবার বন্ধু ধর্ষণ করে গর্ভবতী করেন। তবু সেই মেয়েটিকে গর্ভপাত করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারপর সে দেশে গর্ভপাত নিয়ে যে-গণভোট হয়, তাতেও গর্ভপাতের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। আর, অ্যামেরিকায় আইন থাকলেও সেখানেও একটা বিরাট গোষ্ঠী এর তীব্র বিরোধী। যে-ডাক্তাররা গর্ভপাত করেন, তাদের খুন করার ঘটনাও ঘটেছে সেখানে।
তা সত্ত্বেও মহিলারা থেমে থাকলেন না। গর্ভের সঙ্গে যুক্ত অন্য তাবৎ বিষয় নিয়ে তাঁরা গবেষণা করতে থাকলেন। এমন কি, এ ব্যাপারে পুরুষ বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে আসেন। মেয়েদের সাধারণত কখন গৰ্ভ হয়, গর্ভের সঙ্গে হমেীনের যোগাযোগ কী, সেই হর্মেীনের নিয়ন্ত্রণ করে কিভাবে গৰ্ভ ঠেকিয়ে রাখা যায় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই তারা গবেষণা করতে থাকেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধেই তারা সেটা আবিষ্কার করে ফেলেন। এমন কি, সে রকমের গর্ভনিরোধক বড়িও তৈরি করেন তারা। কিন্তু ১৯৬০ সালের আগে সরকারী অনুমোদন মেলেনি সে বড়িকে আইনসঙ্গতভাবে ব্যবহার করার।
সম্প্রতি (২০০৪) ঢাকার কালি ও কলম পত্রিকায় এই বড়ি বা পিল সম্পর্কে অত্যন্ত তথ্যমূলক এবং মূল্যবান প্ৰবন্ধ লিখেছেন পূরবী বসু। পিল সম্পর্কে যাঁরা আরও জানতে চান, তারা এই প্ৰবন্ধ পড়ে দেখতে পারেন। এই পিল কি করে আবিষ্কার হলো, কারা তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন, এই পিলের গুণাগুণ কী ইত্যাদি সব খবরই আছে। এই প্রবন্ধে। সেই সঙ্গে এই পিল নারীমুক্তিতে যেঅসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে, তারও বিবরণ দিয়েছেন পূরবী বসু। কিন্তু তাঁর প্ৰবন্ধের সমালোচনা হয়েছে। এমন কি, আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েরাও সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বিশেষ করে জোর দিয়েছেন স্বাস্থ্যের ওপর পিলের কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে, তার ওপর। যেমন, তাঁরা বলেছেন যে, বহু বছর ব্যবহার করলে পিল থেকে কোনো কোনো রকমের রোগ হওয়া অসম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, কোন ওষুধটা আছে এই পৃথিবীতে, যা বহু বছর ব্যবহার করলে তা থেকে আর একটা রোগ দেখা দিতে না-পারে? সুতরাং পিলের এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলে পিলের গুণ এবং তার ভূমিকাকে ছোটো করে দেখা আসলে অযৌক্তিক; এবং তা হলে সেটা হবে একটা মহান ব্যাপারকে ছোটো করে দেখার সামিল। পিল ব্যবহারের ফলে মহিলারা নিজেদের পরিবারের আয়তন নিয়ন্ত্রণের অসামান্য অধিকার পেয়েছেন। এমন কি, অনেক মহিলা গোপনে পিল খেয়ে স্বামীর অত্যাচার থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। পিল যুগ যুগ জীউ!