বিশেষ করে এ ধারণা তখন জন্ম নেয়নি যে, নারীও মানুষ এবং সব ব্যাপারে তারা পুরুষের সমান। সত্যি বলতে কি, এ শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন বঙ্গদেশ কেন, পৃথিবীর অন্য কোনোখানেও বিশ শতকের আগে দেখা দেয়নি। বিশ শতকে এসে তবেই পশ্চিমা জগৎও স্বীকার করলো যে, মেয়েরাও মানুষ এবং তাদের শিক্ষা লাভের অধিকার আছে। অবশ্য তখনও পুরুষকুলের বিশ্বাস থাকলো যে, মেয়েদের মেধা পুরুষের তুলনায় নিম্নমানের। লেখাপড়ায় তাঁরা চিরদিন পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে থাকবেন। সুতরাং তারা যখন অফিসে কাজ করতে আরম্ভ করেন, তখন তা হলো কনিষ্ঠ কেরানির। তা ছাড়া, মেয়েদের জন্যে বেতনও নির্ধারিত হলো পুরুষের তুলনায় কম। ১৯৮৬ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটেনেও এ অন্যায় নিয়ম বেআইনী বলে বিবেচিত হয়নি। এমন কি, তখনো এ ধারণা বহুলভাবে প্রচলিত ছিলো যে, ব্যবস্থাপনার কাজে তাদের ওপর নির্ভর করা যায় না। এমন কি, শয্যায়ও তারা নিম্নশ্রেণীর। সেখানে তারা তুলনামূলকভাবে অসক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন। দাপাদাপি করে সুখ নেবেন পুরুষরা।
তবে নারীদের ইতর শ্রেণীর জীব হিশেবে গণ্য করলেও, এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে নিজেদের সঙ্গী করে তোলার প্রয়োজনীয়তা পুরুষরাই অনুভব করেছিলেন, এবং নিজেদেরই স্বার্থে। তাই তার জন্যে উদ্যাগও গ্ৰহণ করেছিলেন তারাই। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত নারীমুক্তির যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে, সেসব বেশির ভাগই হলো: সেই উদ্যোগের কথা–নারীর অবস্থার উন্নতির জন্যে পুরুষরা কী কী করেছেন, তার ইতিহাস। পরবর্তী পর্যায়ে প্রশ্ন দেখা দিলো: পুরুষদের এই তথাকথিত নারীমুক্তির প্রয়াসে মহিলারা কিভাবে সাড়া দিয়েছেন। তার চেয়েও বড়ো কথা নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্যে মহিলারা নিজেরা কী করেছেন? সে জন্যে মোটামুটি ১৯৮০-এর দশক থেকে নারীমুক্তির ইতিহাসের বিষয়বস্তু পাল্টে গেলো। যেমন, বাঙালি মহিলাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে রামমোহন রায়, গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, দুৰ্গামোহন দাস, শিবনাথ শাস্ত্রী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সমাজ-সংস্কারক যে-আন্তরিক প্রয়াস চালিয়েছিলেন সে কথা উষা চক্রবর্তী পর্যন্ত অনেকেই লিখেছিলেন। কিন্তু মহিলারা পুরুষদের সেই প্রচেষ্টার প্ৰতি কেমন সাড়া দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমিই প্রথম বই লিখি “রিলাক্টেন্ট ডেবিউটেন্ট” নামে, ১৯৮২ সালে। এ বইয়ের নাম থেকে পুরুষদের প্রয়াসের প্রতি প্ৰথম দিকের মহিলাদের উৎসাহের অভাবই বোঝা যায়। বই-এর উপশিরোনামে আমি তাই আর-একটু ব্যাখ্যা করে লিখি “রেসপন্স অব বেঙ্গলি উইমিন”। তারপর বাঙালি নারীদের উন্নতির ইতিহাস মেরেডিথ বোর্থউইক, মালবিকা কার্লেকার, মল্লিকা সেনগুপ্ত, সম্বুদ্ধ চক্রবর্তী, চিত্রা দেব ইত্যাদি অনেকেই লিখেছেন। তারাও সবাই পুরুষদের প্রয়াসের বদলে মহিলাদের প্রচেষ্টা এবং প্রতিক্রিয়ার প্রতি বেশি জোর দিয়েছেন।
মেয়েদের মধ্যেও এ সময়ে নারীমুক্তির ধারণা পাল্টে যায়। এক সময়ে মনে করা হতো, মেয়েরা একটু লেখাপড়া শিখলে, বাইরে চলাফেরা করতে পারলে, আধুনিকা ও কেতাদুরস্ত হলে, সন্তান মানুষ করতে পারলে, স্কুলে শিক্ষকতা অথবা অফিসে সেক্রেটারির কাজ পারলে অথবা নার্স হতে পারলে, তার ওপর আবার একটু গানটান জানলে–ব্যস, তাঁরা হলেন বিদগ্ধ, শিক্ষিত, মুক্ত নারী। কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে এসে এ ধারণায় ফাটল ধরে। এ সময়ে মেয়েরা উচ্চশিক্ষার দিকে গেলেন। কেবল তাই নয়, তারা ছেলেদের চেয়ে ভালো ফলাফল করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি পেলেন। অপর পক্ষে, তাদের বড়াই-করা পুরুষ বন্ধুরা থাকলেন পিছিয়ে। অন্যান্য পেশাতেও তেমনি পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করলো।
এখন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও মহিলারা অনেক পুরুষালি কাজ করছেন। গাড়ি চালান, বিমান চালান, পুলিশে কাজ করেন, এমন কি ফৌজী বাহিনীতে যোগ দেন। জজ, ব্যারিস্টার, ডিসি, সচিবের তো কথাই নেই। দেশের অনেক পার্লামেন্ট সদস্যই মহিলা। এমন কি, বাংলাদেশে পর-পর দু-দুজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন। এঁদের “ম্যাডাম, ম্যাডাম” করে পুরুষরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, একজন মহিলাও কর্তৃত্বের পদে বসতে পারেন, এবং বসলে তাঁকে মান্য করতে হয়। সত্যি বলতে কি, রাজনীতির মাধ্যমে মেয়েদের সমান অধিকার যতোটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। এ কথা পশ্চিমা জগৎ সম্পর্কে যেমন সত্য, তেমনি সত্য ভারত, বাংলাদেশ, শ্ৰীলঙ্কা, এমন কি, পাকিস্তান সম্পর্কেও। খালি মধ্যপ্রাচ্যে এখনো ধর্মের মোটা বোরকা দিয়ে এই অধিকার ঢেকে রাখা হয়েছে।
নারীদের প্রতি পুরুষ সমাজের ধারণা একদিনে বদলে যায়নি। অন্তত দেড় শো বছর লেগেছে তার জন্যে। তার ফলে এখন পুরুষদের সঙ্গে বৈষম্যের আইন এবং রীতি দূর হয়েছে। মোটামুটি সমান অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই স্বীকার করতে হবে, এসবের ফলে পরিবার এবং সমাজে নারীদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি পাল্টে গেছে অনেকাংশে। স্বামীদের কাছ থেকে তারা যা আশা করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা পূরণ হয় না। ফলে কেলেঙ্কারীর ভয়ে বিবাহবিচ্ছেদ না-করলেও, পরিবারের ভেতরে আগের তুলনায় মন কষাকষি এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব হলো নারীমুক্তির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক। বিশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসে নারীমুক্তি কেবল নারীদের প্রতি বৈষম্য দূর করার চেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তার ঝোকটা পাল্টে গেছে–এখন আর নারীর উন্নতি নয়, যথার্থভাবেই এবং যুক্তিসঙ্গতভাবেই নারীও যে পুরুষদের মতো সমান মানুষ-নারীসমাজ এটার দিকেই নজর দিয়েছেন। যতো দিন নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না, ততোদিন পুরুষরা অনুগ্রহ করে যেটুকু দিতেন–এমন কি, শয্যায়ও যতোটুকু দিতেন, সেটাকেই সাধারণ মেয়েরা মেনে এসেছেন স্বাভাবিক বলে, কিন্তু জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার পর তার স্বাদ পেয়ে তাদের মনের অবস্থা এবং প্রত্যাশা বদলে গেছে দ্রুত গতিতে।