আমার ঘুম ভেঙে গেলো। স্বপ্ন দেখছিলাম বুঝতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাক, নারীবাদী বিপ্লবের কাল অত্যাসন্ন নয়! এখনো কিছুকাল আমরা নির্বিবাদে নারীদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারবো! দে গরুর গা ধুয়ে!
(প্ৰথম আলো, ডিসেম্বর ২০০৬)
০২. কারও পদতলে বেহেস্ত নয়
বিশ-একুশ শতকে যোগাযোগ ব্যবস্থার এতো উন্নতি হয়েছে যে, তা কল্পনাও করা যায় না। ফলে পৃথিবীটা সত্যি খুবই ছোটো হয়ে গেছে। একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যও এখন আর আগের মতো অবিকৃত রাখা সম্ভব নয়। তাতে এসে মিশে যায় অন্য অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। চীনা খাবার সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। হাট-ডগ আর হ্যাম্বাৰ্গার এখন ঢাকা-কলকাতার তরুণ-তরুণীরা শখ করে খান! যে-ইংরেজরা পঞ্চাশ বছর আগেও ভাত চিনতেন না, রাইস-কারি না-হলে এখন তাদের মুখে রোচে না। কিন্তু সারা বিশ্বের দূরত্ব এতো কমে গেলেও, পৃথিবীর তাবৎ সমাজ অভিন্ন হয়ে যায়নি। সমাজ বরং বহু ভাগে বিভক্ত এখনো। কেবল একটা জায়গায় গোটা বিশ্বের সমাজ এখনো অভিন্ন–সব সমাজ পুরুষশাসিত। পেশী আর আয় করার ক্ষমতা দিয়ে এখনো পুরুষরা মহারাজা নিজের নিজের পরিবারে। এতো বড়ো অন্যায়কে জ্ঞানবিজ্ঞানের অসাধারণ উন্নতি সত্ত্বেও গোটা বিশ্ব মেনে নিয়েছে, এমন কি, সব ধর্মগ্রন্থও কমবেশি একে সমর্থন করেছে। সব ধর্মগ্রন্থেই বলা হয়েছে নারীরা পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট।
স্বামীর পদতলে নারীর বেহেস্ত–কোনো ধর্মগ্রন্থে এমন কথা লেখা নেই। তা সত্ত্বেও মনু থেকে শুরু করে আধুনিক ধর্মগুরুদের ফতোয়া কাজে লাগিয়ে নারীদের হীনতা এবং অধীনতাকে জোরদার করা হয়েছে। এক শতাব্দী আগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো সমাজ-সংস্কারক তাই লিখেছিলেন যে, ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়েই মহিলাদের পদতলে রাখতে চেষ্টা করেন। পুরুষরা। তিনি আরও লিখেছিলেন যে, ধর্মপ্রবর্তকরা মহিলা হলে ধমীয় বিধিবিধান হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। বস্তৃত, ধর্মের নামে মহিলাদের শাসন-শোষণ করার অপচেষ্টা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাই তসলিমা নাসরিনের মতো এ যুগের সংস্কারকরাও ধর্মের সমালোচনায় সোচ্চার হন।
একটু নজর দিলেই দেখা যায়, আজকের জ্ঞানবিজ্ঞানের চরম উন্নতির যুগেও পুরুষরা ধর্মগ্রন্থের দোহাইতো দেনই, তা ছাড়া আরও বিচিত্র উপায়ে স্ত্রীদের দাসীর মতো অধীনে রাখতে চেষ্টা করেন। না, ভুল বললাম, চাকরানির যে-সব মৌলিক অধিকার তাঁরা দিতে বাধ্য থাকেন, স্ত্রীকে তারও সবগুলো দেন না। প্রকৃত পক্ষে, যেসব কাজ চাকরানিরও করতে হয় না, স্ত্রীর তাও করতে হয়। স্বামী-স্ত্রীর বৈষম্য এতো বেসুমার এবং পর্বতপ্রমাণ যে, তার গোটা কয়েক মোক্ষম দৃষ্টান্ত দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবু চেষ্টা করছি। যেমন, ভালো-ভালো রান্নার সিংহভাগ কে খায়? স্বামীরা, না স্ত্রীরা? ঘরের কাজগুলো সবই অথবা বেশির ভাগই কে করে? পুরুষরা, না মেয়েরা? অতি-প্রয়োজনীয় জিনিশের বাইরে যেসব ব্যয় করা হয়, সেই শখ পূরণের বেশির ভাগ ব্যয় কে বেশি করে? পুরুষরা, না। নারীরা? ন মাস ধরে গৰ্ভ ধারণ করার অসহ্য যন্ত্রণা কে সহ্য করে? পুরুষরা, না মেয়েরা? তার পর সেই সন্তান মানুষ করার দায়িত্ব কে বেশি পালন করে? পুরুষরা, না মেয়েরা? এই সন্তান উৎপাদন এবং লালন-পালন করার ব্যাপারে বেশির ভাগ পুরুষের ভূমিকা কী? স্ত্রীকে একবার অথবা কয়েকবার যৌনসঙ্গম করে তার অমূল্য শুক্রাণু দান করা, এই তো! সেই যৌনসঙ্গমের সময়ে স্ত্রী সুখ অথবা চরম সুখ পেলেন। কিনা, তারও হদিস নেন। না পুরুষপ্রবর। তসলিমা নাসরিন যে লিখেছেন, “প্রতি রাতে আমার বিছানায় এসে শোয় এক নপুংসক পুরুষ। … আমাকে উত্তপ্ত করে নপুংসক বেঘোরে ঘুমোয়।”–সে কথা খাঁটি, সর্বাংশে।
কিন্তু স্ত্রীকে শোষণ করে যে সুখ নেই, এমন কি উপযুপরি রমণ করেও সুখ নেই, এটা পুরুষরা অনেক কাল আগেই টের পেয়েছিলেন। ভাষাহীন বালিশ অথবা বস্তার সঙ্গে আদানপ্রদান হয়? অশিক্ষিত স্ত্রী কি একজন শিক্ষিত পুরুষের সঙ্গিনী হয়ে উঠতে পারে? পুত্র জন্ম দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে সত্যিকারের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে একটা উপভোগ্য সম্পর্ক তৈরি হতে পারে? পারে না। ধরা যাক, সমাজে কৃতিত্বযোগ্য কিছু করলে বাড়িতে এসে স্ত্রীকে সেটা খবর হিশেবে জানানো সহজ, কিন্তু তার মর্ম অথবা গুরুত্ব শিক্ষাহীন অথবা বঁদিমার্কা স্ত্রী অনুভব করতে পারবেন। কি? পারবেন না। তাই উনিশ শতক থেকে গোটা বিশ্বেই শিক্ষার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের মধ্যে এক অপূর্ণতার ভাব দেখা দেয়। সেই অভাববােধ থেকে দেখা দেয় স্ত্রীকে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন।
লক্ষ্য করবেন, মেয়েদের স্কুলে যারা লেখাপড়া শেখে, তারা স্ত্রী নয়, বালিকা; তা সত্ত্বেও বাংলায় সেই শিক্ষাকে বলে স্ত্রীশিক্ষা। তার কারণ, উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষিত পুরুষরা গোপনে স্ত্রীদেরই প্রথমে শিক্ষা দিতে শুরু করেন। মেয়েদের শিক্ষার নাম তাই হয়ে যায়, স্ত্রীশিক্ষা। তা ছাড়া, পরে যখন বালিকাদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়, তখনও তাকে বলা হয় স্ত্রীশিক্ষা। কারণ, মেয়েদের স্ত্রী হওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়াই ছিলো তার উদ্দেশ্য। সে যুগে, এমন কি, বিশ শতকের গোড়াতেও, মেয়েদের লিখতে-পড়তে শেখানো হতো, কিছু অঙ্ক করা শেখানো হতো, কিন্তু গুরুত্ব দেওয়া হতো চিঠি লেখার ওপর। বেচারা বালিকারা না-প্ৰেম জানতো, না-জানতো প্রেমপত্র লেখার উপযুক্ত ভাষা। তাই সেকালে চিঠি লেখার অনেক বই প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু এ ধরনের শিক্ষার আয়োজন করলেও কর্তারা অথবা সাহেবরা মেয়েদের পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। কোনো কোনো সংস্কারক বরং মেয়েদের গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদির মতো বিষয় না-শেখানোর দাবি করেছেন। তাদের মতে, এ সব বিষয় শেখালে নারীদের কোমলতা বিনষ্ট হতে পারে।