চার
নারীমুক্তির ধারা
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে নারীদের মধ্যে শিক্ষার যথেষ্ট প্রসার ঘটে–যদিও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার অধিকার স্বীকার করে নেয়নি। এমন কি, চাকরি-বাকরিতেও তাদের অধিকার তেমন গৃহীত হয়নি। তখনো মেয়েদের চাকরি বললে বোঝাতো শিক্ষকতা আর নার্সিং। তারপর নারীরা ঘরের বাইরের কাজে ব্যাপক সংখ্যায় এগিয়ে আসেন প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে। তখন পুরুষদের অনেকেই গিয়েছিলেন যুদ্ধে। নিহতও হয়েছিলেন লাখ লাখ। ফলে কলকারখানা চালানো থেকে আরম্ভ করে বিচিত্র ধরনের কাজে মহিলাদেরই অংশ নিতে হয়েছিলো। এমন কি, যুদ্ধের প্রস্তুতির কাজেও তাঁরা সাহায্য করেছিলেন। যুদ্ধের সময়ে এই দেশসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯১৮ সালে তাদের ভোটের অধিকার না-দিলেও নির্বাচনে প্ৰতিযোগিতা করার অধিকার দেওয়া হয়। ভোটের অধিকার তারা লাভ করেন আরও দশ বছর পরে–১৯২৮ সালে। ইংল্যান্ডের ভোটাধিকারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমিলি ডেভিস, এমিলিন প্যাঙ্কহ্যাক্ট, এলিজাবেথ গ্যারেট অ্যান্ডারসন প্রমুখ নারীবাদী। এঁদের মধ্যে প্যাঙ্কহ্যাস্ট এই অধিকার আদায় করতে গিয়ে কারা বরণ করেছিলেন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে চাকরি-করা মহিলার সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও তাদের চাকরির ক্ষেত্রে যদ্দূর সম্ভব বৈষম্য বজায় রাখে পুরুষ সমাজ। উচ্চপদে না-বসানো, একই কাজের জন্যে তাদের কম বেতন দেওয়া, কতোগুলো কাজের জন্যে তাদের অনুপযুক্ত বিবেচনা করা–এসব ছিলো সেই বৈষম্যের অংশ। কিন্তু নারীবাদীদের অব্যাহত আন্দোলনের ফলে গত বিশ-পাঁচিশ বছরে পুরুষরা তাদের অধিকার প্রায় সবটাই স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখনও ব্যবস্থাপনার কাজে অথবা কর্মস্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে পুরুষ সমাজ রক্ষণশীলতা দেখায়। কিন্তু নারীদের অধিকার মেনে নিতে পুরুষ সমাজ বাধ্য হয়েছে। তা ছাড়া, নারীরা এখন এমন সব পেশায় নামছেন, যাতে আগে তাদের কল্পনা করা যেতো না। বাস, লরি, ট্রেন, বিমান ইত্যাদি চালানো, বাড়িঘর নির্মাণের মতো তথাকথিত পুরুষালি কাজ তাঁরা এখন করছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। এমন কি, এখন তাঁরা নিজেরাই ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং ক্রমবর্ধমান মাত্রায় তাতে সাফল্য লাভ করছেন।
ইংল্যান্ডের মতো পশ্চিমা অন্য দেশগুলোতেও মোটামুটি একই সময়ে নারীদের অধিকার বৃদ্ধির আন্দোলন চলেছে এবং তাতে সাফল্য এসেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভোটাধিকারের কথা বলা যেতে পারে। ইংল্যান্ডের অনেক আগেই তাদের উপনিবেশ অষ্ট্রেলিয়া এবং নিউজীল্যান্ডে ভোটাধিকার দেওয়া হয় ১৯০২ সালে। ইউরোপের মধ্যে সবার আগে নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। ফিনল্যান্ডে–১৯০৬ সালে।
নরওয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, জাৰ্মেনি ও সুইডেন, আয়ারল্যান্ড এবং ফ্রান্স এই অধিকার মেনে নেয়। যথাক্রমে ১৯১৩, ১৯১৭, ১৯১৮, ১৯১৯, ১৯২১ এবং ১৯৪৫ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নারীদের ভোটাধিকার দেয়। ১৯২০ সালে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভোটাধিকার স্বীকার করে নিলেও পশ্চিমা জগতে দীর্ঘকাল রাজনীতিতে নারীদের নেতৃত্ব পুরুষরা মেনে নেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজও কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। ইংল্যান্ডে প্রথম নারী প্ৰধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে— ভারতের পনেরো বছর পরে। ফ্রান্সের নারীরা খুব আধুনিক বলে তাদের খ্যাতি-অখ্যাতি দুইই আছে। কিন্তু সেই ফ্রান্সে এখনো কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। জাৰ্মেনিতে সবেমাত্ৰ মহিলা চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন।
বেশির ভাগ দেশে নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হলেও পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব এখনো আনুপাতিকভাবে খুব কম, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে। ২০০৪ সালে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে পার্লামেন্টে নারী সদস্যদের হার ছিলো শতকরা ৩৬ থেকে ৪৫। তারপর আইসল্যান্ড, জার্মেনি, নেদারল্যান্ডস এবং স্পেনে শতকরা ৩০ থেকে ৩৬। কিন্তু যে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে নারীবাদের সূচনা হয়েছিলো, সে দু দেশে এই হার ছিলো যথাক্রমে ১৫ এবং ১৮।
বাঙালি নারীদের দিকে তাকালে লক্ষ্য করি যে, গত অর্ধ-শতাব্দীতে তাদের বৈপ্লবিক উন্নতি হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত শিক্ষা ধীরে ধীরে চালু হলেও, ডিগ্রি নিয়ে তারা পরিবারকে অলংকৃত করতেন। কাজে লাগাতেন না। কিন্তু গত পঞ্চাশ বছরে তাঁরা অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসেন। বিশেষ করে দেশবিভাগ এবং দাঙ্গা-পরবর্তী পশ্চিম বঙ্গে এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে মহিলারা রাতারাতি অর্থনৈতিক কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রক্ষণশীল সমাজে মহিলাদের পক্ষে অবাধ নির্বাচনে জয়ী হওয়া এখনো শক্ত।
উপার্জন, ভোটাধিকার ইত্যাদি ছাড়া নারীবাদীদের আর-একটা বড়ো দাবি হলো রান্নাবান্না-সহ ঘরের কাজে পুরুষদের সমান অংশ গ্রহণ। অর্থাৎ এ দায়িত্ব কেবল নারীদের নয়, পুরুষদেরও তা সমানভাবে পালন করতে হবে। কিন্তু পুরুষ-সমাজ এর বিরোধিতা করে যুক্তি দেখায় যে, তারা উপার্জন করেন, সুতরাং নারীরা ঘরের কাজ করবেন— যেন উপার্জন করাটা ঘরের কাজের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। এর কারণ, পুরুষদের উপার্জন করার বিষয়টা যতোটা স্পষ্টভাবে সবার চোখে পড়ে, নারীদের ঘরের কাজ তেমন করে পড়ে না। ধরেই নেওয়া হয় যে, সেটা চাকরির মতো কোনো কঠিন কাজ নয়, তাতে কোনো যোগ্যতা লাগে না এবং সেটা জন্মগতভাবে নারীদেরই দায়িত্ব। পুরুষ মোট কতো উপার্জন করলেন, সেটা বেতনের হিশেবে নির্দিষ্টভাবে বলা যায়। কিন্তু নারীরা ঘরের কাজ বাবদে কোনো টাকা পয়সা পান না বলে এই কাজের কোনো সুনির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ করা যায় না। সাম্প্রতিক কালে জাতিসজেঘর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘরের কাজের মূল্য নির্ধারণ করা হলে দেখা যাবে যে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি উপার্জন করেন। আর যে-নারীরা বাইরেও কাজ করেন, তাদের উপার্জন পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি। কেবল তাই নয়, জাতিসজ্যের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি সময় ধরে কাজ করেন।