তবে তাঁর সম্পর্কে আরও একটা কথা বলা দরকার যে, তিনি জঙ্গী নারীবাদী ছিলেন না। কারণ নারীদের অবস্থা উন্নত করার কাজে সহায়তা করার জন্যে তিনি পুরুষদের আহবান জানিয়েছেন। তাঁদের তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, নারী এবং পুরুষ সমান না-হলে অসমান চাকাওয়ালা গাড়ির মতো গোটা সমাজই এক জায়গায় দাড়িয়ে ঘুরপাক খেতে থাকবে। সুতরাং পুরুষদের উচিত তাদের নিজেদের উন্নতির জন্যেই নারীদের শিক্ষিত করে তোলা। কিন্তু তিনি পুরুষদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নারীস্বাধীনতা অর্জনের কোনো সুপারিশ করেননি। সেদিক থেকে তিনি অত্যাধুনিক নারীবাদীদের মতো নন।
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে তুলনা করলে লক্ষ্য করা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে স্ত্রীশিক্ষার প্রসার আগে থেকে হওয়ায়, সেখানে নারীবাদী মনোভাব যতোটা দানা বেঁধেছে, মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশে ততোটা বঁধেনি। মুসলমান সমাজে এমনিতেই রক্ষণশীলতা বেশি। তার ওপর, সেখানে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন হয় তুলনামূলকভাবে দেরিতে এবং বর্তমানে সেখানে নারীদের শিক্ষার হার পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় যথেষ্ট নিচুতে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের মধ্যে নারীবাদী চিন্তা যাদের রচনায় বেশ লক্ষ্য করা যায়, তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন মহাশ্বেতা দেবী, কেতকী কুশারী ডাইসন, নবনীতা দেবসেন, সুস্মিতা সেন, বুলা চৌধুরী এবং সংযুক্তা দাশগুপ্ত। অপর্ণা সেনও চলচ্চিত্রে নারীবাদী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তবে এরা কেউ কট্টর নারীবাদী নন। বাংলাদেশে পূরবী বসু, দিলারা হাশিম, মালেকা বেগম, সেলিনা হোসেন, সনিয়া আমিন প্ৰমুখের রচনায় নারীবাদী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সত্যিকারের নারীবাদের চেয়ে বাংলাদেশে বরং নারীদের অতি হীন অবস্থা থেকে খানিকটা উপরে টেনে তোলার মতো মনোভাব অনেক বেশি লক্ষ্য করা যায়।
নারীবাদীদের মধ্যে যাঁরা রীতিমতো জেহাদী, তাঁরা হলেন নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী। অর্থাৎ তাঁরা মনে করেন যে, নারীরা পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তাদের মতে, পুরুষরা যা যা করতে পারেন, নারীরা তা সবই পারেন। তদুপরি, নৈতিক এবং অন্যান্য দিক দিয়ে পুরুষের থেকে তাদের অবস্থান উচ্চতর। যেমন, মেরি ডেলির মতে পুরুষদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেলে বিশ্বের অবস্থা অনেক উন্নত হবে। এই নারীবাদীরা নারীদের অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অনেক সময়ে পুরুষদের হেয় এবং নিন্দা করেন। বলা বাহুল্য, পুরুষদের পক্ষে এই ধারণা অথবা দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই নারীরাও তাই পুরুষদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না অথবা পুরুষদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করাও তাদের পক্ষে শক্ত। এঁরা অনেকে আবার পুরুষদের আন্তরিকভাবেই ঘূণা করেন। যৌনতার দিক দিয়েও এদের অনেকে তাই লেসবিয়ান অর্থাৎ নারীদেরই যৌনসঙ্গী হিশেবে নির্বাচন করেন।
চরমপন্থী নারীবাদের প্রত্যক্ষ শিকার হলেন পুরুষরা। এর ফলে দেখা দিতে পারে পুরুষ নির্যাতন এবং পুরুষদের প্রতি বৈষম্য। সে জন্যে মধ্যপন্থী নারীবাদীরা নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী ধারণা সমর্থন করেন না। তাঁরা বরং অনেকে মনে করেন যে, এই মত মেনে নিলে নারী ও পুরুষ সমান–এই ধারণাকে অস্বীকার করতে হয়। তাদের মতে, এ রকমের নারীবাদ এক ধরনের লিঙ্গবৈষম্যের কথা বলে। সুতরাং সেটা আদর্শ স্থানীয় হতে পারে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল সমাজে নারীশ্রেষ্ঠত্ববাদী থাকা প্ৰত্যাশিত নয়। তবে কেউ কেউ হয়তো তসলিমা নাসরিনের মতো নারীবাদীকে উগ্ৰ নারীবাদী বলতেও পারেন। নারীরা পুরুষদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ–এটা তসলিমা নাসরিন বিশ্বাস করেন কিনা, সেটা তাঁর রচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা না-গেলেও, তিনি যে পুরুষদের ঘৃণা করেন, সেটা অনেক সময়ে প্রকাশ পায়। কেবল তাই নয়, যেহেতু পুরুষরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীদের শাসন ও শোষণ করেছেন, সুতরাং তিনিও পুরুষদের ব্যবহার করে ছিবড়ের মতো ফেলে দিতে চান–এ কথা তিনি তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন।
বস্তুত, নারীদের রক্ষা করার জন্যে অনেক সময়ে পুরুষদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে গাৰ্হস্থ্য সহিংসতায় পুরুষদেরই সাধারণত দায়ী করা হয়। কর্মস্থানে যৌন হয়রানির অভিযোগ করলেও সাধারণত পুরুষদের বিশ্বাস না-করে নারীদেরই বিশ্বাস করা হয়। ধর্ষণের অভিযোগ করলেও সাধারণত পুরুষদেরই সন্দেহ করা হয়। বাংলাদেশের নারী নির্যাতন আইনে পুরুষদের প্রতি বৈষম্য দেখানো হয়েছে বলে আমার ধারণা। এ কথা ঠিক যে, নারীদের রক্ষা করার ব্যাপারে এ আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং এ ধরনের পুরুষ-প্রধান সমাজে নির্যাতনের হাত থেকে নারীদের বাঁচানোর জন্যে কঠোর আইন থাকাও উচিত, কিন্তু এই আইনের ফলে কখনো কখনো পুরুষরা অন্যায্যভাবে অসুবিধায় পড়তে পারেন। পশ্চিমা বিশ্বেও গাৰ্হস্থ্য সহিংসতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষদের দায়ী করা হলেও কখনো কখনো মহিলারাও দায়ী থাকেন। কিন্তু মহিলারা দায়ী এটা সাধারণত কেউ বিশ্বাস করে না।
নারীবাদ সবচেয়ে প্রবলভাবে প্ৰকাশ পেয়েছিলো। ১৯৭০-এর দশকে। তখন নারীরা নতুন-পাওয়া নারীবাদের স্বাদে বিশেষ উচ্ছসিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯০এর দশক থেকে তাদের মধ্যে এ সম্পর্কে নতুন করে ভাববার প্রবণতা দেখা দেয়। তাঁরা অনেকেই প্রশ্ন করেন, সংসারে সমানাধিকার পেলেই কি নারীরা সবচেয়ে সুখী হবেনা? ১৯৭০-এর দশক থেকে তারা কেউ কেউ এ অধিকার ভোগ করে লক্ষ্য করেছেন যে, সমানাধিকার পেলেই জীবনে সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণতা এবং সুখ লাভ করা যায় না। স্বামী অথবা পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে মারামারি করে অধিকার আদায় করেই সংসারে শান্তি আসে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে সংসারে দুঃখ নেমে আসে। বাস্তবের তিক্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা অনুভব করেন যে, সুখ এবং তৃপ্তি কেবল অধিকারের ওপর নির্ভর করে না। ক্ষমতার চেয়ে আনন্দ বড়ো। এই চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে আরম্ভ হয়। উত্তর-নারীবাদী বা পোষ্ট-ফেমিনিস্ট আন্দোলন। এখনো এই আন্দোলন চলছে। এখনো এই বিতর্ক শেষ হয়নি।