তিন
নারীবাদের বিভিন্ন শাখা
ধর্ম এবং কমিউনিজমের যেমন অনেকগুলো শাখা-প্ৰশাখা আছে, নারীবাদেরও তেমনি অনেকগুলো ধারা আছে। এক দল যাঁদের নারীবাদী বলে মনে করেন, অনেকে আবার তাঁদের আদৌ নারীবাদী বলে স্বীকারই করেন না। যেমন, তত্ত্বগতভাবে পুরুষদের পক্ষে নারীবাদী হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, একজন পুরুষ নিজেকে নির্যাতিত নারীসমাজের সদস্য হিশেবে চিহ্নিত করতে পারেন না। তিনি বড়ো জোর হতে পারেন নারী-দরদী। এই নারী-দরদী পুরুষরা নারীদের সমানাধিকারের কথা বললেও নির্যাতিত নারীসমাজের হয়ে পুরুষদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেননি। সুতরাং সত্যিকারের নারীবাদীরা এঁদের নারীবাদী বলে মেনে নিতে নারাজ। কিন্তু নারীজাগরণের ইতিহাস-লেখকদের অনেকে এই নারী-মুক্তির সমর্থক পুরুষদেরও নারীবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বঙ্গদেশে প্রথম যিনি নারী-জাগরণের কথা লিখিতভাবে প্ৰকাশ করেন, তিনি রামমোহন রায়। সেদিক দিয়ে তিনি বঙ্গদেশের প্রথম নারীবাদী। তার পর ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, দুৰ্গামোহন দাস, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি প্রমুখ যে-সমাজসংস্কারকরা নারীদের শিক্ষা এবং মর্যাদা দানের জন্যে আন্দোলন করেন, তারাও সবাই সীমিত অর্থে নারীবাদী। কিন্তু আগেই বলেছি, বর্তমানে নারীবাদের যে-সংজ্ঞা প্রচলিত আছে, তাতে নারীবাদী বলে ঐরা বিবেচিত হতে পারেন না। শুধু এ জন্যে নয় যে, ঐরা পুরুষ; বরং এটাই বড়ো কারণ যে, এঁরা সবাই নারীদের সমানাধিকারের দাবিও করেননি। কেউ কেউ কেবল শিক্ষা দান করে এবং পর্দা থেকে অংশত মুক্ত করে নারীদের অবস্থা কিঞ্চিৎ উন্নত করার দাবি জানিয়েছিলেন। এমন কি, কেউ কেউ নারীদের উচ্চশিক্ষার বদলে সীমিত শিক্ষা দানের পক্ষপাতী ছিলেন।
যে-নারীদের সত্যিকারভাবে নারীবাদী বলে স্বীকার করা হয়, তাদের আমরা তিন ভাগে ভাগ করে দেখতে চাই–নরমপন্থী, মধ্যপন্থী আর চরমপন্থী। নরমপন্থীরা নারীদের ন্যূনতম অধিকার থাকলেই সন্তুষ্ট। চরমপন্থীরা পুরুষদের তুলনায় নারীদের শ্ৰেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। তা ছাড়া, তারা অনেকে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যে চরম ব্যবস্থা নিতে চান। এঁদের বলা যায়, জঙ্গী নারীবাদী। কিন্তু মধ্যপন্থীরা কেবল বিশ্বাস করেন যে, নারী আর পুরুষের অধিকার সমান। ইংরেজিতে দুই লিঙ্গের এই সমান অধিকারকে বলা হয়: জেন্ডার ইগালিটারিয়ানিজম। যারা এই মতে বিশ্বাসী তাদের চোখে নারীও মানুষ এবং পুরুষদের মতো সমান মানুষ। এঁরা এমনও বিশ্বাস করেন। যে, কেবল নারীদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে পুরুষের বিরোধিতা করলে তার ফলে এক ধরনের লিঙ্গবৈষম্য প্রকাশ পেতে পারে। এঁদের দাবি হলো ন্যূনতম। তাঁরা চান যে, শিক্ষা, উপার্জন, ঘরের কাজ, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভূমিকা ইত্যাদিতে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার এবং সমান সুযোগ থাকবে।
বাঙালিদের মধ্য থেকে দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, নরমপন্থী নারীবাদী ছিলেন কৃষ্ণভাবিনী দাস। তিনি সমাজ-সংসারে নারীদের অধিকতর মর্যাদা থাকার কথা লিখেছিলেন তাঁর প্রথম গ্ৰন্থ ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলায় (১৮৮৫)। ইউরোপের নারীদের দেখে দেশের নারীদের দুর্দশা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছিলেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন যে, আমাদের দেশের নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ কখনোই পান না। তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে তিনি তাই প্রথমেই তাদের ভালো শিক্ষা দানের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি নিজে মেয়েদের স্কুল খুলে সেখানে শিক্ষা দেওয়ার কাজও করেছিলেন। তা সত্ত্বেও নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদা পাবেন–এ কথা তিনি বলেননি।
অপর পক্ষে, তাঁর দু দশক পরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রথম সত্যিকারের নারীবাদী হিশেবে আত্মপ্ৰকাশ করেন। কারণ তিনি শুধু নারীদের অবস্থার উন্নত করতে হবে–এ কথা বলেননি, বরং নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা রীতিমতো যুক্তি দিয়ে বলেছেন। সেই সঙ্গে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, নারীদের কেবল উপার্জনের অধিকার থাকাই উচিত নয়, বরং তাদের অবশ্যই উপার্জন করতে হবে। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না-থাকলে তাঁরা সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ অথবা পরিবারে সমান সম্মান পেতে পারেন না।
সত্যি বলতে কি, ১৯০০/০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর মতিচূরের একাধিক প্ৰবন্ধ বিশ্লেষণ করলে তাঁকে শুধু সমানাধিকারবাদী বলা যায় না। নারীদের পুরুষের সমান হতে হবে–এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, পুরুষ ছাড়া অন্য কোনো আদর্শ দেখানো যাচ্ছে না বলেই তিনি লিখেছেন নারীদের হতে হবে পুরুষদের সমান। পুরুষরা যা যা করতে পারেন, তার মতে, নারীরা তার সবই করতে পারেন। এমন কি, পুরুষের মতো তারা মাঠে গিয়ে কৃষিকৰ্মও করতে পারেন। কিন্তু এর অতিরিক্ত তাদের এমন কিছু গুণ আছে, যা পুরুষদের নেই। তিনি যেভাবে এ কথা লিখেছেন, তা থেকে ধারণা হতে পারে যে, তার মতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা শ্ৰেষ্ঠ, যদিও সরাসরি তিনি এ কথা লেখেননি। সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থে তিনি পুরুষদের ঘরের কাজের দায়িত্ব দান করে নারীদের দিয়ে দেশ ও সমাজ পরিচালনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি নারী-শাসিত আদর্শ সমাজের যে-ছবি এঁকেছিলেন, তা পুরুষ শাসিত সমাজের তুলনায় অনেক উন্নত এবং সংঘাতবর্জিত। এ থেকেও মনে হতে পারে যে, তিনি নারীদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করতেন।