মেয়েদের শিক্ষার প্রতি এই যে বিরোধিতা, তা কেবল ভারতবর্ষ অথবা অনুন্নত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশেও স্ত্রীশিক্ষা— বিশেষ করে নারীদের উচ্চশিক্ষা–সহজে প্ৰচলন করা যায়নি। এর বিরুদ্ধে উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে নারীবাদীদের রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। অক্সফোর্ড-কেমব্রিজও ১৯২০ এর দশকের আগে পর্যন্ত মেয়েদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অধিকার স্বীকার করে নেয়নি। সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার ১৮৮৫ সালের আগে পর্যন্ত সে দেশে ছিলো না। ১৯২৮ সালের আগে পর্যন্ত ভোট দেওয়ার অধিকারও ছিলো না তাদের। শিক্ষা, সম্পত্তি এবং ভোটের অধিকার আদায় করার জন্যে উনিশ শতকের মধ্য ভাগ থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথম সিকি ভাগ পর্যন্ত নারীবাদীদের নানা ধরনের আন্দোলন করতে হয়েছে–আন্দোলন করতে হয়েছে সেই পুরুষ সমাজের বিরুদ্ধে যারা ঐ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মনে করতেন, মেয়েদের মননশক্তি নেই অথবা থাকলেও আছে। পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। এই আন্দোলন করতে গিয়ে বিশ শতকেও নারীকর্মীদের কারাবাস করতে হয়েছে। শতাব্দীর শেষে এসেও তসলিমা নাসরিনের মতো নারীকর্মীকে নির্বাসনে যেতে হয়েছে।
শিক্ষা এবং ভোটাধিকার আদায় করার জন্যে যারা আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের বলা যেতে পারে প্রথম যুগের নারীবাদী। কিন্তু আজকের নারীবাদীদের চোখে তাঁরা নারী-জাগরণের পথিকৃৎ ছিলেন, যথার্থভাবে নারীবাদী ছিলেন না। অত্যাধুনিক নারীবাদীরা এ ধরনের ন্যূনতম অধিকার ছাড়া সমাজ এবং সংসারে নারীদের অবস্থান সম্পর্কেই অনেক মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
সত্যি বলতে কি, আজও অনেক দেশে শিক্ষাদীক্ষায় মেয়েদের ন্যায্য অধিকার নেই। অথবা থাকলেও পুরুষ সমাজ এবং পুরুষ-শাসনে অন্ধ কিছু নারী সেই অধিকার দিতে চান না। বরং সেই অধিকার হরণ করতে চান। যেমন, কিছু কাল আগে আফগানিস্তানে মধ্যযুগীয় ধারণা নিয়ে যখন তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছিলো, তখন তারা মেয়েদের শিক্ষার অধিকার তো হরণ করেই ছিলো, এমন কি, যে-নারীরা শিক্ষিত ছিলেন, তাঁদের পর্দার আড়ালে ঠেলে দিয়ে তাঁদের শিক্ষাকে অস্বীকার করেছিলো। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, মহিলা ডাক্তারদের চিকিৎসা করার অধিকার পর্যন্ত তারা কেড়ে নিয়েছিলো। ইরানে আয়াতউল্লাহ খোমেনি এসেও মহিলাদের অন্তত এক প্ৰজন্ম পিছিয়ে দিয়েছেন। যে-ইরানী নারীরা রীতিমতো উচ্চশিক্ষা লাভ করে আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন, ইসলামী বিপ্লব-পরবর্তী নারীরা তার অনেকটাই বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন–পােশাকে, চলাফেরায় এবং পরিবারের বাইরে সামাজিক ভূমিকা পালন করায়। আজও সৌদী আরবের মতো কতোগুলো মুসলিম দেশে মেয়েদের ভোটাধিকার নেই। সৌদী আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানো পর্যন্ত নিষেধ। এ ধরনের বৈষম্য দূর করার ধারণা থেকেই নারীবাদী চিন্তার জন্ম হয়েছিলো।
এমন কি, নারীদের বাঁচার অধিকার নিয়েও কোনো কোনো সমাজে নারীকমীদের আন্দোলন করতে হয়। কারণ, পৃথিবীর বহু সমাজে এখনো পুত্ৰ সন্তানকে কন্যা সন্তানের চেয়ে বেশি বাঞ্ছিত বলে মনে করা হয়। আফ্রিকা এবং এশিয়ার বহু দেশ সম্পর্কেই এ কথা সত্য। এমন কি, ভারত অথবা চীনের মতো বেশ উন্নত দেশেও পুত্র এবং কন্যার মধ্যে এই ভেদ বজায় রয়েছে। ভারতের বহু জায়গায় কন্যা সন্তান মেরে ফেলার কথা প্রায়ই শোনা যায়। ভারতে নতুন যা ঘটছে, তা হলো: স্ক্যান করে যদি জানা যায় যে, গর্ভস্থ সন্তানটি কন্যা–তা হলে সেই মায়েরা গর্ভপাত করাচ্ছেন। আর, চীনে একটি মাত্র সন্তান রাখার আইন গৃহীত হওয়ার পর থেকে সেখানে ব্যাপক হারে কন্যা সন্তান হত্যার খবর অনেক বারই প্ৰকাশিত হয়েছে। বহু বছর ধরে এই রীতি চলার ফলে চীনের বহু জায়গায় এখন নারী-পুরুষের অনুপাতে সমতা নেই। অনেক জায়গায়। তাই বিয়ের জন্যে পাত্রী জোটানো একটা সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
দুই
নারীবাদের সূচনা
ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ছিলো সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্বের। এর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে নারীরা ১৭৮০-র দশকের শেষ দিকে সমানাধিকার দাবি করেছিলেন। কিন্তু বিপ্লব থিতিয়ে এলে অল্পকালের মধ্যে এ দাবি তার তেজ হারিয়ে ফেলে। ফলে নেপোলিয়নের সময়ে যে-আইন প্রণীত হয়, তাতে এই অধিকার অগ্রাহ্য করা হয়। তার কয়েক দশক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন গৃহীত হয়, তখনো এই দাবি তোলা হয়েছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে উদারপন্থী নেতারাও যথেষ্ট উদার হতে পারেননি।
সত্যিকারের নারীবাদী কণ্ঠ প্ৰথমে শোনা যায় মেরি ওলস্টোনক্রাফটের গ্রন্থে। নারীদের অধিকার সম্পর্কে তাঁর সেই বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো। ১৭৯২ সালে। এ গ্রন্থ নারীপুরুষ সবাইকেই ভাবিয়ে ছিলো তখন। কিন্তু এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো নারীবাদী আন্দোলন সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়নি, কারণ তার পরিবেশ তখনো তৈরি হয়নি। সেই আন্দোলনের সূচনা লক্ষ্য করি ১৮৪৮ সালে। তখন বেশ কিছু মার্কিন নারীকর্মী একটি সম্মেলনে নারীদের জন্যে অধিকতর সুযোগসুবিধার দাবি জানান নিউ ইয়র্ক শহরে। এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এলিজাবেথ স্ট্যানটন এবং লুক্রেশিয়া মট। তারা যে-ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাকে তাঁরা নারী স্বাধীনতার ঘোষণা বলেন। তাতে শিক্ষা ও ভোটের অধিকারসহ আইন, বাণিজ্যিক ও উপার্জনের সুযোগসুবিধা, বেতন ইত্যাদিতে নারীদের সমানাধিকার দাবি জানান তারা। বলা যেতে পারে নারীবাদের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় সেই সভায়। তারপর ইউরোপ হয়ে এখন সারা বিশ্বেই এই সচেতনতা কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে–যদিও তার মাত্রা এক-এক সমাজে এক-এক রকম। শিক্ষাদীক্ষায় যে-সমাজ যতো অগ্রসর এবং উন্নত, সে সমাজে নারীদের অধিকার ও সম্মান ততো বেশি স্বীকৃত হয়েছে। অনুন্নত সমাজে নারীরা এখনো পুরুষদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছেন। জাতিসঙ্ঘ্য ১৯৫২ সালে নারীদের সমানাধিকারের দাবি স্বীকার করে নেয় নিউ ইয়র্কের ঘোষণায়। নিঃশর্তভাবে এতে নারী এবং পুরুষদের অধিকার সমান বলে স্বীকৃত হয়েছে। তা ছাড়া, বেইজিং সম্মেলনে নারীদের ক্ষমতায়নের ঘোষণাও দেওয়া হয় এক দশক আগে। তা সত্ত্বেও আজও বিশ্বের বহু দেশে নারীদের ন্যায্য এবং মৌলিক অধিকার গৃহীত হয়নি।