এক
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, পুরুষরা প্রধানত মাংসপেশী আর উপার্জনের ক্ষমতা দিয়ে প্রাচীন কাল থেকে নারীদের বন্দী করে রেখেছেন। বন্দী করে। রেখেছেন চার দেয়াল এবং পর্দার বেড়া তৈরি করে। তারপর সেই বন্দী নারীদেরই যথেচ্ছ শাসন ও শোষণ করেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের এই বন্দীত্ব এবং নিচু অবস্থানকেই স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে। ঐতিহ্যিক সমাজে এখনো নারীদের তুলনায় পুরুষরা উচ্চতর আসন অধিকার করে আছেন। এখনো পুরুষরা প্ৰায় সবাই বিশ্বাস করেন যে, নারীরা তাদের চেয়ে ছোটো–শারীরিক শক্তিতে তো বটেই, এমন কি, মননশক্তি, সাধারণ বুদ্ধি, ব্যবস্থাপনা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতায়ও। যা আশ্চর্যের বিষয় তা হলো: মেয়েরা নিজেরাও একে স্বাভাবিক, এমন কি, ন্যায্য বলে মেনে নিয়েছেন। যুগ যুগ ধরে নারীরাও বিনা তর্কে এই মূল্যবোধে বিশ্বাস করে এসেছেন এবং তাদের কন্যাদেরও তাদের শৈশব থেকে এটা মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই নারীপুরুষের ভেদ বজায় ছিলো এবং এখনো অনেকটাই আছে। ফলে লিঙ্গবৈষম্যকেই স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা হয়। এতে আরও মনে করা হয় যে, পুরুষরা নারীদের থেকে প্রাকৃতিকভাবেই শ্রেষ্ঠ এবং নারী ও পুরুষের ভিন্ন ভূমিকাই পালন করার কথা।
কেবল শারীরিক শক্তি এবং উপার্জনের ক্ষমতা দিয়েই নয়, নারীবাদীদের মতে, ধর্মের দোহাই দিয়েও পুরুষরা নারীদের নিমাবস্থানকে স্থায়ী করে রাখার চেষ্টা করেছেন। ধর্মের বিধানসমূহ বিশ্লেষণ করলে এই দাবির মধ্যে সত্যতা নেই–তা বলা যায় না। মনু যেভাবে নারীদের নিচু চোখে দেখেছেন এবং নারীদের সম্পর্কে যেবিধান দিয়েছেন, বর্তমান কালের ম্যাসকুলিষ্ট অর্থাৎ পুরুষবাদীরাও তা মেনে নিতে লজ্জা পাবেন। মনুর মতে, নারীদের অন্তঃকরণ নির্মল নয়; বেদস্মৃতিতে তাদের অধিকার নেই; তাঁরা ধৰ্মজ্ঞানবর্জিত; মিথ্যা পদাৰ্থ পুরুষ পেলেই তাঁরা সম্ভোগে মিলিত হতে চান; তাদের চিত্তের স্থিরতা নেই; পুরুষ দেখলেই তাদের মনে কামভাব জেগে ওঠে; শয্যা, আসন, ভূষণ, কাম, ক্ৰোধ, কুটিলতা এবং পরহিংসা তাদের সহজাত প্ৰবৃত্তি। নারীরা নরকের দ্বার এবং নরকের কীট।
খৃস্টধর্ম অনুসারেও নারীরা বহু পাপের উৎস। তাঁরা পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে সন্তান জন্মদান, বাড়ি এবং স্বামীর। সে জন্যে ধর্মের সঙ্গে তাদের কোনো যোগ নেই। এখনো খৃস্টধর্মের কোনো কোনো শাখা মহিলাদের ধর্ম প্রচারের ভূমিকা দিতে রাজি নয়। ইসলামেও নারীরা পুরুষদের তুলনায় নিকৃষ্ট। পুরুষের তুলনায় তাদের মননশক্তিও কম। দুজন নারীর সাক্ষ্য তাই একজন পুরুষের সমান। এমন কথা চালু আছে যে, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক স্বৰ্গ পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেছিলেন যে, নরকে যারা শাস্তি পাচ্ছে, তারা বেশির ভাগই নারী। নারীরা ধর্ম প্রচার করবে–এটাও ইসলামে প্রত্যাশিত নয়। মোট কথা, সব ধর্মেই নারীদের অনেক হেয় করে দেখা হয়েছে। অন্তত নারীরা যে পুরুষের তুলনায় নিকৃষ্ট-ধর্মে ধর্মে মারামারি থাকলেও এই ব্যাপারে সব ধর্মই একমত।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ধর্মপ্রচারকরা সবাই ছিলেন পুরুষ, সে জন্যে তাঁরা নারীদের হীনাবস্থাকেই ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে স্থায়িত্ব এবং দৈব মর্যাদা দিয়ে গেছেন। অর্থাৎ নারীদের চিরকাল বশে রাখার জন্যেই পুরুষরা এসব ধমীয় অনুশাসন তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁর মতে, ধর্মপ্রচারকরা নারী হলে এসব বিধান হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।
মোট কথা, শারীরিক শক্তি, উপার্জন ক্ষমতা এবং ধর্মীয় বিধান–যে-প্রক্রিয়া দিয়েই হোক না কেন, পুরুষরা নারীদের চিরদিন নিজেদের তুলনায় ছোটো করে রেখেছেন এবং হেয় করে দেখেছেন। নারীরাও বিরোধিতা না-করে মুখ বুজে। সেই নির্যাতন এবং শোষণকে মেনে নিয়েছেন। এই মূল্যবোধ অস্বীকার করে পুরুষের মতো অধিকার লাভ করার আন্দোলন শুরু করা তাদের পক্ষে আদৌ সহজ ছিলো না। কারণ পুরুষরা খুশি মনে অথবা বিনা বাধায় তাদের উচ্চাসন এবং বর্ধিত অধিকার ছেড়ে দেবেন, এটা স্বাভাবিক নয়। সে অধিকার নারীদের সংগ্রাম করেই আদায় করতে হয়েছে। এ আন্দোলন বেশি দিন আগে শুরুও হয়নি।
গোড়াতে এ আন্দোলন ছিলো মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তা-ও পুরুষরা সহজে দিতে চাননি। কারণ, প্রথমত তাঁরা বিশ্বাসই করতেন না যে, লেখাপড়া শেখার মতো মননশক্তি মেয়েদের আছে। কিন্তু যখন তাঁরা দেখলেন যে, নারীরা লেখাপড়া শিখতে পারেন, তখন তাঁরা আশঙ্কা করলেন যে, শিক্ষার সুযোগ দিলে মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবেন। এই বঙ্গদেশে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সমাজ বিশ্বাস করতো যে, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে নিৰ্ঘাৎ বিধবা হবেন। এমন কি, মহিলারাও এটা বিশ্বাস করতেন। তা ছাড়া, সমাজ মনে করতো। যে, শিক্ষা দিলে মহিলারা হবেন স্বামী এবং অন্য গুরুজনদের অবাধ্য। ঘরের কাজেও তাদের মন থাকবে না। সে জন্যে গোটা উনিশ শতক ধরে স্ত্রীশিক্ষা-বিরোধী শক্তি প্রবলভাবে কাজ করেছে। কেশব সেনের মতো প্ৰগতিশীল সমাজ-সংস্কারকও বলেছিলেন যে, বিদ্যালয়ে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, তার সবগুলো মেয়েদের উপযোগী নয়। যেমন অঙ্ক এবং বিজ্ঞান শেখালে মেয়েদের কমনীয়তা নষ্ট হতে পারে। স্ত্রীশিক্ষা সম্পর্কে মুসলিম সমাজে বিরোধিতা ছিলো আরও বেশি। সে জন্যে বিশ শতকের প্রথম তিন দশক ধরে চেষ্টা করেও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বেশি। মুসলমান মেয়েকে তাঁর স্কুলে আনতে পারেননি।