তবে বাংলা অভিনয়ের এই এক শো বছরের ইতিহাসে কতোগুলো ইতিবাচক দিকও ছিলো। প্রথমে অভিনেত্রীদের আগমনে রুচিবান ভদ্রলোকেরা থিয়েটার দেখাই বন্ধ করেছিলেন। কিন্তু এ মনোভাব স্থায়ী হয়নি। ধীরে ধীরে তাঁরা মঞ্চে যেতে আরম্ভ করেছেন। এমন কি, শেষে নিজেদের কন্যা এবং স্ত্রীদের মঞ্চে উঠতে দিয়েছেন, রূপালি পর্দায় হাজির হতে উৎসাহিত করেছেন। কেউ বা অভিনেত্রীদের ঘরের বেঁী করে এনেছেন। নারীদের প্রতি পুরুষপ্রধান বাঙালি সমাজে যেটুকু শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছে, তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। শিক্ষাবিস্তার তার মধ্যে সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাবিস্তার থেকে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। কিন্তু সেই সঙ্গে খানিকটা কৃতিত্ব এই অভিনেত্রীদেরও প্রাপ্য। তাঁরা নিজেরা সমাজের কাছে গৃহীত হয়েছেন। এবং সামগ্রিকভাবে নারীদের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন।
অভিনেত্রীদের দেখে দর্শকরা এখন আর ঘূণা করেন না, বরং তাদের দেখতে ভিড় জমান। তাদের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলেও নিজেদের ধন্য মনে করেন। তাদের বিয়ে করতে পারলে অনেক ভদ্রলোক এখন ধন্য মনে করবেন। আর, যেবীরপুরুষরা তাদের বিয়ে করতে সংকোচ বোধ করবেন, তারা তাদের ফাও উপভোগ করার সুযোগ পেলে বর্তে যাবেন।
অভিনেত্রী হওয়ার সুযোগ পেলে এখন অনেক ভদ্রমহিলাই জীবনকে সফল মনে করবেন। সবচেয়ে বেশি যা লক্ষণীয়, তা হলো: অভিনেত্রীরা নিজেরাও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হয়েছেন। তাঁরা বিনোদিনীর মতো বিনয় প্রকাশ করবেন না। বস্তৃত, একটা সামাজিক এবং জাতীয় সমস্যা নিয়ে তাঁরা যে শাবানা আজমী অথবা অপর্ণা সেনের মতো একটা বলিষ্ঠ প্রতিবাদী অবস্থান নিতে পারছেন, তা একদিনে সম্ভব হয়নি। তার পেছনে রয়েছে। শতবর্ষের অর্জনের ইতিহাস।
সত্যি বলতে কি, বাংলা থিয়েটার ও সিনেমার ইতিহাসে পরিচালক এবং প্রযোজকরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন, তেমনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বহু অভিনেত্রী। তাঁরা কেবল বাংলা থিয়েটার এবং চলচ্চিত্ৰকে এগিয়ে দেননি এবং তাকে জনপ্রিয় করেননি, বরং বাঙালির প্রাত্যহিক জীবন, চলাফেরা, পোশাক ইত্যাদিতেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। এ রকম প্রভাবশালী অভিনেত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন। বিশেষ করে যাদের নাম মনে
সুচিত্রা। তাঁরা যে-গান মঞ্চে এবং পর্দায় গেয়েছেন, সে গান জনপ্রিয় হয়েছে। যেভঙ্গিতে শাড়ি পরেছেন, সেই ভঙ্গি ভদ্রমহিলারা অনুকরণ করেছেন। তাদের ভঙ্গিতে কথা বলা রপ্ত করেছেন। খোপা বেঁধেছেন। এমন কি, সুচিত্রার মতো চুলও ছোটছেন অনেকে। বাঙালি মহিলাদের রুচি গঠনে এবং আত্মমর্যাদা অর্জনে এই অভিনেত্রীদের ভূমিকা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
(অন্যদিন, নববর্ষ সংখ্যা, ১৪১৩)
০৬. নারীবাদের সহি সবক
পঁচিশ বছর আগেও নারীবাদ শব্দটা বাংলা ভাষায় ছিলো না। মোটামুটি তখনই বাঙালি নারীদের নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলাম, কিন্তু তাতে এ শব্দটা ব্যবহার করিনি। আমি। তখনো নারীদের উন্নতি বোঝানোর জন্যে যে-পরিভাষা চালু ছিলো, তা হলো: নারীস্বাধীনতা অথবা নারীমুক্তি। ‘নারীপ্রগতি’ এবং নারীদের আধুনিকতা’ কথা দুটোও আমি ব্যবহার করেছিলাম। আমার ধারণা ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিক থেকে দু-একজন করে নারীবাদ শব্দটা ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন। সাম্যবাদ, সমাজবাদ, পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাশিবাদ ইত্যাদির অনুকরণে ফেমিনিজমের অনুবাদ করা হয় নারীবাদ। ইংরেজিতে শব্দটা আসে ল্যাটিন ফ্যামিনা শব্দ থেকে, তার সঙ্গে ইজন্ম লাগিয়ে। সে যাই হোক, নারীবাদ ঠিক কী বস্তু সেটা আমাদের সবার কাছে দশ-পনেরো বছর আগেও পরিষ্কার ছিলো না, এখনো সম্ভবত নেই। এমন কি, যারা এ বিষয়ে লেখেন, তাদের সবার ধারণাও যে খুব পরিষ্কার, তা মনে হয় না। বস্তৃত, অনেকে এ শব্দটা ব্যবহার করেন ঢালাওভাবে–নারীমুক্তি অথবা নারীস্বাধীনতা–এই অর্থে।
ইংরেজিতে ১৮৩৭ সালে যখন এই শব্দটা প্ৰথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়, তখনো ঢালাওভাবেই ব্যবহৃত হয়েছিলো। নারীবাদ বললে তখন বোঝাতো নারীদের অধিকার আদায়ের অথবা তাদের উন্নতির আন্দোলন। কিন্তু এখন ফেমিনিজম কথাটার একটা বিশেষ তাৎপৰ্য আছে। নারীবাদেরও থাকা উচিত।
যাঁরা গরিবদের প্রতি দয়া করার কথা বলেন অথবা দাবি জানান গরিবদের অবস্থা উন্নত করার, তারা সবাই সমাজতন্ত্রী অথবা কমিউনিস্ট নন। কমিউনিজম এবং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে একটা মতবাদ অথবা রাজনৈতিক ধারণার যোগ আছে। মানবিকতার কথা বললেই সমাজতান্ত্রিক অথবা কমিউনিষ্ট হওয়া যায় না; বরং সমাজতান্ত্রিক অথবা কমিউনিস্ট তাঁদেরই বলা যায়, নিজেদের যারা শোষিত একটি গোষ্ঠীর–প্রোলেটারিয়েট গোষ্ঠীর–সদস্য বলে চিহ্নিত করেন এবং পুঁজিবাদী শোষণ দূর করার উদ্দেশে একটা বিশেষ সমাধানে বিশ্বাস করেন। ফেমিনিজম অথবা নারীবাদও তেমনি। সত্যিকার অর্থে ফেমিনিস্ট সেই নারীরা, যারা নিজেদের গণ্য করেন। পুরুষদের হাতে নির্যাতিত নারীসমাজের একজন সদস্য হিশেবে। নারীদের অবস্থা উন্নত করার কথা বললেই তাই নারীবাদী বলা যায় না–বড়ো জোর তাদের বলা যায় নারী-দরদী। নারীবাদীকে তাঁর অধিকার এবং তা আদায় করার পন্থা সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।