১৯৫০-এর দশকে সমাজের নিষেধ এতোটাই দুর্বল হয়ে এসেছিলো যে, অভিজাত ঘরের বাইশ-তেইশ বছরের একজন স্ত্রী এবং সন্তানের জননী–সুচিত্রা সেনও সিনেমার অভিনয় করতে এগিয়ে আসেন। তার শ্বশুর আদিনাথ সেন এবং স্বামী দিবানাথ তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন। স্বামীর কাছ থেকে সুচিত্রা কেবল অনুমতি আদায় করেননি, তিনি স্বামীকে সঙ্গে নিয়েই ছবির জগৎ খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। স্বামীকে তিনি বর্ম হিশেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। অসম্ভব নয় যে, তার স্বামী এবং শ্বশুর মনে করেছিলেন যে, কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেই সুচিত্রার শখ মিটে যাবে এবং ঘরের বৌ ঘরে ফিরে আসবেন। কিন্তু অভিনয়ের জগতে এসে সুচিত্রা খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের প্রতিভার যথার্থ জায়গা। তার অভিনয়ের যদি বা সীমাবদ্ধতা থাকেও, যা অসীম পরিমাণে পেয়েছিলেন তিনি, তা হলো খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা। থিয়েটারে তাঁর চেয়ে যোগ্য অভিনেত্রী তাঁর আগে এবং পরে আরও এসেছিলেন, কিন্তু বাংলা সিনেমার জগতে তার চেয়ে কোনো অভিনেত্রীই বেশি খ্যাতি লাভ করেননি। তিনি ৫৩টি বাংলা এবং অন্য ভাষায় ৭টি ছবি করেছিলেন। এর বেশির ভাগই দর্শকদের মন কেড়েছিলো।
রোম্যান্টিক নায়িকার অভিনয়ের নতুন আদর্শ স্থাপন করেছিলেন সুচিত্রা। তাঁর অসামান্য সৌন্দর্য, কথা বলার ভঙ্গি, স্মার্ট পােশাক, প্ৰেমবিহবল মুগ্ধ দৃষ্টি, নায়কের সঙ্গে সংকোচহীন ঘনিষ্ঠতা তরুণ-তরুণীদের মনে প্রেমিক-প্রেমিকার আদর্শ তুলে ধরেছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারে নিজেদের জীবনে যা ছিলো না, কিন্তু মনে মনে যে-জীবন তাঁরা কল্পনা করতেন, তারই প্রতিফলন তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন সুচিত্রা-উত্তমের অভিনয়ে। এমন কি, সুচিত্রা যখন বসন্ত চৌধুরী, অশোককুমার অথবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছেন, তখন তাও খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রোম্যান্টিক ভূমিকার সঙ্গে তাঁর নাম এমন সমাৰ্থক হয়ে গিয়েছিলো যে, যখন তিনি চল্লিশের কোঠার শেষ দিকে পৌঁছলেন, যখন আর তাঁর পক্ষে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করা সম্ভব ছিলো না, তখন তিনি পর্দা থেকে একেবারে পুরোপুরি সরে গেলেন, কানন দেবী অথবা অন্য সবার মতো মায়ের ভূমিকায় অথবা পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হলেন না। আমার ধারণা, এ থেকে একদিকে তার অত্যুজ্জ্বল পেশাদারী মনোভাব এবং সেই সঙ্গে আত্মমর্যাদা প্ৰকাশ পায়। তিনি সিকি শতাব্দী ধরে নিজের যে-ভাবমূর্তি দর্শকদের মনে তৈরি করেছিলেন, কোনো কিছুর বিনিময়ে তা বিসর্জন দিতে প্ৰস্তৃত ছিলেন না। সুযোগ পেলে বিনোদিনী কী করতেন, বলা শক্ত। কিন্তু কাৰ্যকারণে তিনিও আজীবন নায়িকাই থেকে গিয়েছিলেন।
বস্তুত, সুচিত্রার জনপ্রিয়তা কেবল তাকে বড়ো করেনি, বাংলা সিনেমারও অসাধারণ উপকার করেছিলো। বিশেষ করে তিনি উত্তমকুমারের সঙ্গে যে-তিরিশটি ছবি করেছিলেন, তা দর্শকদের হিন্দী ছবির দিক থেকে বাংলা ছবির দিকে নিয়ে এসেছিলো। নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় সুচিত্রা-উত্তমের জুটি বাংলা সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি। শুধু সিনেমাকে নয়, এই জুটি তাদের অভিনয় দিয়ে বাংলা গানকেও শ্রোতাদের অন্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহু গান রেকর্ডে শ্রোতাদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করতো। কিনা সন্দেহ আছে, কিন্তু সিনেমার পর্দায় সুচিত্রা এবং উত্তম ঐ গান গাওয়ার অভিনয় করে সেসব গানকে অসাধারণ জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
পেশাদারী ও ব্যক্তিগত জীবনে কানন এবং সুচিত্রার সফলতা-নিস্ফলতা থেকে আরও একবার নারী এবং অভিনয় সম্পর্কে বাঙালি সমাজের দ্বৈতমানদণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়। কানন দেবী এবং সুচিত্রা দুজনেই খুব সুন্দরী ছিলেন। যতো নিচুঘরের কন্যা হন না কেন, অভিনেত্রী কাননকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন অনেকেই। যে-হেরম্ব মৈত্র থিয়েটারের পথ কোনদিকে পথচারীকে তা বলে দেননি, সেই হেরম্ব মৈত্রের পুত্ৰ ব্যারিস্টার অশোক মৈত্র আভিজাত্যের পঙক্তি এবং জাত ভেঙে তাকে বিয়ে করেন। তবে যে-পারিবারিক পিউরিটান মূল্যবোধের মধ্যে অশোক বড়ো হয়েছিলেন, হয়তো সে কারণেই কাননের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। কানন তাকে কতোটা ভালোবেসেছিলেন জানিনে, কিন্তু ১৯৪৮ সালে তিনি রাজ্যপালের একজন উচ্চকর্মকর্তার প্রেমে পড়েন। এই প্ৰণয়ের গভীরতা অনুভব করা যায়। তাঁর আত্মজীবনী থেকে। এই কর্মকর্তা–হরিদাস ভট্টাচাৰ্য ছিলেন। অশোক মৈত্রের মতোই ব্ৰাহ্মণ। তাঁর সঙ্গে কাননের বিয়ে হয় এবং বাকি জীবন তারা যদ্দুর মনে হয় সুখেই বাস করেন। হরিদাস অল্পদিনের মধ্যে কাননের মতোই প্ৰবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতে, তবে অভিনেতা হিশেবে নয়, পরিচালক এবং প্রযোজক হিশেবে।।
সুচিত্রার বিয়েও সুখের অথবা খুব দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি যখন সিনেমাজগতে প্ৰবেশ করেন, তখনও তিনি তা করেছিলেন ছদ্মনামে। তাঁর আসল নাম ছিলো রমা। অসম্ভব নয় যে, এই নামের আড়ালে তিনি এবং তাঁর পরিবার তাঁর সত্যিকার পরিচয় খানিকটা ঢেকে রাখতে চেয়েছিলেন। তারপর একের পর এক রোম্যান্টিক নায়িকার চরিত্রে সুচিত্রার প্রাণবস্ত এবং অন্তরঙ্গ অভিনয়কে তাঁর স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের অন্য সদস্যরা সম্ভবত বাস্তব বলেই গণ্য করেছিলেন। ফলে বিয়ের পনেরো-ষোলো বছর পরে–১৯৬৩ সালে–তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। কানন বিয়ে ভেঙে যাবার পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন; সুচিত্রা তা করেননি। মাত্র ৩৪-৩৫ বছর বয়স থেকে এই অসাধারণ সুন্দরী এবং গুণী মহিলা বস্তৃত নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। আর তার স্বামী ক্ষোভে, দুঃখে, পরনিন্দার ভয়ে দেশ থেকে চলে যান অনেক দূরে–অ্যামেরিকায়। সেখানেই তিনি মারা যান। ১৯৬৯ সালে। সুচিত্রা নিজেও ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেন। এবং নিজেকে একেবারে গুটিয়ে বন্দী করেন চার দেওয়ালের মধ্যে। সুকুমারী থেকে আরম্ভ করে অন্যসব অভিনেত্রীর মতোই গুরুর কাছে দীক্ষা নেন। তিনি এবং ধর্মকর্মে আত্মনিয়োগ করেন। অভিনেত্রী জীবনে অন্য পুরুষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং রূপ ও দেহকে দেখিয়ে দর্শকচিত্তকে আকৃষ্ট করা যে পাপের–এ কথা রক্ষণশীল সমাজের মতো তারা নিজেরাও বিশ্বাস করেছেন। সে জন্যেই সম্ভবত সুকুমারী থেকে সুচিত্রা পর্যন্ত সবাই পাপবোধ থেকেই শেষ জীবনে ধৰ্মকর্মে মন দিয়েছিলেন। আর সমাজের সমালোচনা এড়ানোর জন্যেই বোধহয় অনেক অভিনেত্রী সত্যিকারের নাম গোপন করে মঞ্চে নেমেছিলেন নকল নামের আড়ালে—সুকুমারী থেকে সুচিত্রা পর্যন্ত।