তাঁকে প্রথম জীবনে সবচেয়ে খ্যাতি এনে দিয়েছিলো মুক্তি (১৯৩৭)। পরের বছর বিদ্যাপতি এবং সাথীও জনপ্রিয় হয়েছিলো। ৪০-এর দশকের গোড়ায় তিনি পরিচয় এবং শেষ উত্তর ছবির জন্যে তিনি পর-পর দুবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান। বস্তৃত, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪— এই সময়টাই নায়িকা হিশেবে তাঁর সবচেয়ে খ্যাতির পর্ব। এ সময়ে কাননীবালা থেকে তিনি সন্ত্রান্ত কানন দেবীতে পরিণত হন। তার বয়সও হয় বছর তিরিশ।
অতঃপর তিনি রোম্যান্টিক নায়িকার বদলে স্ত্রী এবং মায়ের ভূমিকায় বেশি মানানসই হন। তিনি অভিনয়ে শান্ত সৌম্য সৌন্দর্য দিয়ে মায়ের যে-আদর্শ স্থাপন করেন, তা ছিলো অসাধারণ। মুক্তি ছবিতে তাঁর রোম্যান্টিক নায়িকার অভিনয় সাত দশক পরে এখন মনকে আন্দোলিত করবে। কিনা, সন্দেহ হয়। কিন্তু তাঁর মেজদিদির অভিনয় এখনো দর্শকের কাছে আদর্শ অভিনয় বলেই গণ্য হবে। কেবল মেজদিদি নয়, আলোচ্য কালে তিনি শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি বেশ কয়েকয়েকটি ছায়াছবিতে তিনি অভিনয় করেন। পাঠকরা যেভাবে শরৎচন্দ্রের নায়িকাদের মানস দৃষ্টিতে কল্পনা করে নিয়েছিলেন, কানন দেবীর মধ্যে তাঁরা সেই চরিত্রগুলোকে যেন বাস্তবে দেখতে পেলেন।
তিনি নিজেও তার এই শক্তির কথা জানতেন। সে জন্যে ১৯৪৮ সালে তিনি যখন নিজেই শ্ৰীমতী পিকচার্স নামে চলচ্চিত্রের কম্পোনি গড়ে তোলেন, তখন বেশির ভাগ ছবিই করেছিলেন শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে। সেসব ছবিতে তিনি নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই কম্পোনিতে এসে তিনি কেবল অভিনয় এবং প্রযোজনাই করেননি, তিনি পরিচালকের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
কাননের আর-একটি পরিচয় তিনি অভিনয় করতে করতে বিখ্যাত গায়িকায় পরিণত হন। বাড়ির কাছের একজন সাধারণ গায়কের কাছে হাতেখড়ি হলেও, পরে তিনি ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শেখেন। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, নজরুল ইসলাম, অনাদি দস্তিদার, পঙ্কজ মল্লিক প্রমুখের কাছেও তিনি নানা ধরনের গান শিখেছিলেন। কেবল বহু আধুনিক গান নয়, বহু রবীন্দ্রসঙ্গীতও তিনি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান–আজি সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে–গেয়ে তিনি যে কেবল রবীন্দ্রনাথকেই খুশি করেছিলেন, তাই নয়, এ গানকে তিনি ভদ্রলোকের বসার ঘর থেকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তার গাওয়া আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ, যদি ভালো না লাগে তবে দিও না মন, আমি বনফুল গো, অনাদি কালের স্রোতে ভাসা ইত্যাদি গান ছিলো সেকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান।
কানন দেবীই সম্ভবত সমাজের নিচের তলা থেকে আসা শেষ বড়ো অভিনেত্রী। ১৯৪০-এর দশক থেকে পরিবার এবং সমাজ ভদ্রঘরের মহিলাদের অভিনয় মোটামুটি গ্রহণ করে নেয়। আমরা এর আগেই প্রেমিকা দেবী, দেবিকারাণী, সাধনা বসু, কঙ্কাবতী, তৃপ্তি মিত্র এবং শোভা সেনগুপ্তের মতো এই শ্রেণীর কয়েকজন অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ করেছি। শিক্ষার বিকাশ, অভিনয় থেকে খ্যাতি এবং আর্থিক লাভ ইত্যাদি। অনেক মহিলা এবং পরিবারকে এ দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে থাকবে। কোনো কোনো সিনেমার পরিচালক যে তাদের আত্মীয়াদের সিনেমায় নামিয়েছিলেন, তাও ভদ্রমহিলাদের অভিনয়ের পথ সুগম করেছিলো। এমন কি, অভিনেত্রীরা যে-ঘর থেকেই আসুন না কেন, কোনো সিনেমা-পরিচালক এবং সমাজের ওপর তলার পুরুষরা যে তাঁদের বিয়ে করছিলেন, তাও অভিনেত্রীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিলো। তবে তখনো থিয়েটারে অভিনয় যতোটা গ্রহণযোগ্য ছিলো, সিনেমায় অভিনয় অতোটা নয়। সিনেমার পর্দায় যতোটা শরীর এবং নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠতা দেখানো হয়, চোখের সামনে মঞ্চে ততোটা দেখানো হয় না। এ হয়তো এর একটা কারণ। এখনো সিনেমা এবং মঞ্চে এই পার্থক্য এবং সে সম্পর্কে সমাজের মনোভাব বজায় আছে।
কানন দেবী তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে কিশোর বয়স থেকেই তাঁকে পর্দায় নগ্নতার অভিনয় করতে হয়েছে। তা ছাড়া, পর্দার বাইরেও কখনো নায়ক, কখনো পরিচালকের লোলুপতার শিকার হতে হয়েছে। কেউ হাত ধরে টানাটানি করেছেন, কেউ পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করেছেন, কেউ হাতে টাকা গুঁজে দিয়েছেন ইত্যাদি। তাদের বাসনার যথাযথ উত্তর না-দেওয়ায় তারা পরে কিভাবে তার প্রতিশোধ নিয়েছেন, সে কথাও কানন লিখেছেন। জোরবরাত (১৯৩১) ছবির একটি দৃশ্যে সংলাপের পর হঠাৎ নায়ক তাঁকে জড়িয়ে ধরে ইংরেজি কায়দায় ঠোঁটে চুমু খান। কাননের বয়স তখন বছর ষোলো। এতে তিনি এতো হকচাকিয়ে যান যে, ধাক্কা দিয়ে নায়ককে সরিয়ে দেন। পরে এ জন্যে পরিচালক আর এ দৃশ্য দেখাতে পারেননি। কানন দেবী, বলা বাহুল্য, দারুণ ব্যথিত এবং অপমানিত হয়েছিলেন। পরিচালক তাকে জানান যে, নায়ক যা করেছিলেন, তা তারই নির্দেশে করেছিলেন। কিন্তু কাননকে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। অভিভাবকহীন নিচুঘরের মেয়ে হওয়ায় টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে অথবা অভাবের সুযোগ নিয়েও নগ্নতা প্রদর্শনের জন্যে বাধ্য করা হয়েছে। এ রকমের একটি ছবি ছিলো বাসবদত্তা। তিনি এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন নিতান্ত অনিচ্ছায়। হয়তো সে জন্যেই নগ্নতা সত্ত্বেও এ ছবি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। তাঁর অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে প্রযোজকরা কিভাবে তাঁকে টাকা পয়সার ব্যাপারে ঠকিয়েছেন, তাঁর আত্মজীবনীতে সে সম্পর্কেও বর্ণনা আছে।