সুপ্ৰভা মুখোপাধ্যায়ের জন্মও চন্দ্রাবতীর মতো। ১৯০৯ সালে। তিনিও ছিলেন ভদ্রঘরের কন্যা এবং বধূ। সেকালে আইএ পাশ করেছিলেন। তাঁর স্বামীর সঙ্গে পরিচালক মধু বসুর পরিচয় ছিলো। সেই সূত্র ধরে এবং স্বামীর উৎসাহে তিনি অভিনয়ের জগতে প্ৰবেশ করেন। মধু বসু নিজের স্ত্রী সাধনা বসুকেও সিনেমায় নামিয়েছিলেন। নামিয়েছিলেন বললে কম বলা হয়। কারণ সাধনা রীতিমতো খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মর্জিনা চরিত্রে তার অভিনয় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলো। নাচ এবং গান উভয় বিষয়ে তিনি নৈপুণ্য লাভ করেছিলেন। কেবল ওস্তাদদের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নয়, তিনি শচীন দেববর্মণ এবং হিমাংশু দত্তের কাছে বাংলা গানও শিখেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন কেশব সেনের পুত্র এবং পেশায় ব্যারিস্টার।
পরিচালক অথবা অভিনেতাদের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে আরও কয়েকজন মহিলা অভিনয় করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। জ্যোৎস্না গুপ্ত যেমন। তাঁর পিতা ছিলেন প্ৰথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হীরালাল সেনের ছাত্র এবং আত্মীয়। প্রতিমা দাশগুপ্তের পিতা ছিলেন পদস্থ কর্মকর্তা এবং এনজিনিয়ার। এ রকম অভিজাত ঘরের মেয়ের অভিনয় করার কথা নয়। কিন্তু তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
পারিবারিক পটভূমি এবং পরিবারের সদস্যদের উৎসাহও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের অভিনয়ে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দেবিকারানীর (জন্ম ১৯০৮) পিতা কর্নেল চৌধুরী ছিলেন মাদ্রাসের সার্জন জেনারেল। আর দেবিকা নিজে লেখাপড়া আর অভিনয় শিখেছিলেন ইংল্যান্ডে। পরিচালক হিমাংশু রায়ের আহবানে তিনি ভারতে ফিরে নির্বাক ছায়াছবিতে অংশ নেন। তারপরই ১৯২৯ সালে তিনি হিমাংশু রায়কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে ১৯৪০ সালে হিমাংশু রায় মারা না-যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গে একযোগে বহু ছবিতে কাজ করেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি নিজেই চলচ্চিত্ৰ প্ৰযোজনা এবং পরিচালনা করেন। তিনিই ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা পরিচালক।
তরু ও অরু দত্তের বংশের মেয়ে দেবযানী দত্ত বিএ বিটি পাশ। তার স্বামী ছিলেন আইসিএস কর্মকর্তা। একে নিজের খৃস্টান পটভূমি, তার ওপর স্বামীর উৎসাহে তিনি অভিনয়ে এসেছিলেন। প্রতিমা দাশগুপ্তও অভিনয় জগতে ঢুকেছিলেন অনেকটা রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায়। পরে তিনি চিত্র পরিচালনাও করেছিলেন। শোভা সেনগুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯২৩ সালে আর তৃপ্তি মিত্র ১৯২৫ সালে। দুজনই উচ্চবংশের মেয়ে। শোভা সেনগুপ্তের পিতা ছিলেন ডাক্তার। তিনি নিজে বেথুন থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। কলেজে অভিনয় করে খানিকটা অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন আর স্বামীর উৎসাহে যোগ দিয়েছিলেন আইপিিটএ-র সঙ্গে। তৃপ্তি মিত্ৰও যোগ দিয়েছিলেন আইপিটিএ-র সঙ্গে। তার পিতা ছিলেন উকিল আর মা বিপ্লবী রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন।
প্রথম মুসলমান অভিনেত্রী বনানী চৌধুরীও (জন্ম ১৯২৪) স্বামীর উৎসাহে এ পথে এসেছিলেন। তার জন্যে এ পথ ছিলো দ্বিগুণ কঠিন। ইসলাম ধর্মে অভিনয় নিষিদ্ধ এবং পর্দাপ্রথাও কঠোর। তখনকার দর্শকরাও মুসলমানদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল ছিলেন না। সে জন্যে তাঁর মূল নাম আনোয়ারা গোপন রেখে বনানী নাম নিয়ে তাকে অভিনয় করতে হয়েছিলো। প্ৰসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন ভদ্রঘরের অন্য মহিলারাও কেউ কেউ সত্যিকার নাম গোপন রেখে অভিনয়ে নেমেছিলেন। ভদ্রঘরের কোনো কোনো মহিলা অভাবে পড়েও অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেমন, সুনন্দা দেবী (জন্ম ১৯২১), সরযুবালা দেবী (জন্ম ১৯১২) এবং মলিনা দেবী (জন্ম ১৯১৪)। প্ৰভা দেবী, শিশুবালা এবং রমা বসুও–দারিদ্র্যের কারণে অভিনয় করেছিলেন। ভদ্রঘরের মহিলাদের মধ্যে মলিনা দেবী অথবা আঙুরবালার মতো কেউ কেউ মঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন নৃত্যশিল্পী হিশেবে গোড়াতে তারা অভিনয় করতেন না। পরে অভিনেত্রী হন। ইন্দুবালার মতো কেউ কেউ এসেছিলেন গায়িকা হিশেবে। মোট কথা, বিশ শতকের প্রথম ৩০ বছর বিশেষ বিশেষ কারণেই ভদ্রঘরের স্বল্পসংখ্যক মহিলা অভিনয়-জগতে এসেছিলেন। নয়তো তখনো বেশির ভাগ অভিনেত্রী আসতেন যাদের কুলশীলের পরিচয় নেই, এমনসব পরিবার থেকে।
অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু তার পরবর্তী তিন বছরের তিনি কোনো বিবরণ দেননি। হয়তো নিতান্ত গ্ৰানির মধ্যে কেটেছিলো বলে।
তাঁর সত্যিকারের অভিনয়-জীবন শুরু হয়। ১৯৩০ সালে ৷ ততোদিনে চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাকে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর এ পর্বের প্রথম ছবি জোর বরাত। এ ছবি মুক্তি পেয়েছিলো। ১৯৩১ সালে। এর পরের তিন বছর তিনি বসে থাকেননি। তবে সিনেমার-জগতে তিনি নিজের আসন পাকা করেন যে-ছায়াছবি দিয়ে তা হলো: ১৯৩৫ সালের মানময়ী গার্লস স্কুল। ততোদিনে তিনি ভরা যৌবনে পৌঁছেছিলেন। চলচ্চিত্রের ইতিহাসকার রবি বসু লিখেছেন যে, এ সময়ে কাননীবালাকে দেখে যুবক এবং প্রৌঢ় অনেকেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতো। রূপবাণী সিনেমায় এই ছবির একটি রোম্যান্টিক দৃশ্যে কাননের অভিনয় দেখে একদিন এক উদ্রান্ত যুবক নাকি পর্দার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন একবার কাননবালাকে একটু স্পর্শ করার জন্যে। কলকাতার রাস্তায় ধারে চট বিছিয়ে কাননের আলোকচিত্র বিক্রি হতো। এ সময়ে। সৌন্দর্যে এবং ফ্যাশনে কানন এ সময়ে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। মহিলারা তার ফ্যাশনের শাড়িব্লাউজ পরতে আরম্ভ করেন। তার ফ্যাশনের কানের দুল তৈরি করান।