জনসাধারণের প্রবেশাধিকার না-থাকলেও, ঠাকুর পরিবার নিজেদের বাড়ির মহিলাদের মঞ্চে উঠিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। প্রথমত, এটা পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে দৃষ্টান্ত হিশেবে কাজ করেছিলো। এই দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে সিকি শতাব্দী পরে ভদ্রলোক পরিবারের মহিলারা মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, অবতীর্ণ হবার সাহস পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, ঠাকুরবাড়ির মহিলারা যাত্রার মতো অতিনাটকীয় এবং অস্বাভাবিক অভিনয়ের বদলে স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন। তাও পরবর্তীদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিলো। থিয়েটারের অভিনেতারা (হয়তো অভিনেত্রীরাও) গোপনে ঠাকুরবাড়ির অভিনয় দেখে গিয়ে সে রকম অভিনয় করেছিলেন বলে সমসাময়িক লেখা থেকে জানা যায়। এমন কি, তারা নাকি ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের মতো অঙ্গভঙ্গিও শিখেছিলেন।
নাটকের ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির আগ্রহের একটি কারণ ছিলো এই যে, সে বাড়িতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ–দুজনই অনেকগুলো নাটক লিখেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একাধিক নাটক ১৮৭০-এর দশকে সাধারণ রঙ্গমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিলো। এ রকমের একটি অভিনয় দেখার জন্যে মহিলাদের নিয়ে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা বেঙ্গল থিয়েটারে গিয়েছিলেন। সেখানে বাইরের দর্শকদের সেদিন আসতে দেওয়া হয়নি। আর, রবীন্দ্রনাথ প্রথমে গীতিনাট্য দিয়ে শুরু করলেও ১৮৮০-এর দশক থেকে আরম্ভ করে পরে অনেকগুলো উৎকৃষ্ট নাটক লিখেছিলেন।
ঠাকুরবাড়ির নিজস্ব মঞ্চে প্রথম অভিনয় শুরু হয় বাল্মীকি-প্রতিভা দিয়ে, ১৮৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাতে রবীন্দ্রনাথ নিজে সেজেছিলেন বালীকি, আর তার ভ্রাতুষ্পপুত্রী প্রতিভা সেজেছিলেন সরস্বতী। লক্ষ্মী সেজেছিলেন শরৎকুমারী দেবীর কন্যা সুশীলা। তারপর গোটা ১৮৮০-এর দশক ধরে আরও কয়েকবার এই গীতিনাট্যের অভিনয় হয়েছিলো। প্রতিবারেরি তাতে ঠাকুর পরিবারের অথবা তাঁদের আত্মীয় পরিবারের মেয়েরা অংশ নিয়েছিলেন। ১৮৮২ সালে কালমৃগয়ার অভিনয়ে ইন্দিরা দেবীসহ আরও কয়েকটি মেয়ে অংশগ্রহণ করেন। ১৮৮৮ সালে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের উদ্যোগে বেথুন কলেজে মায়ার খেলা অভিনীত হয়। এতে অংশ নিয়েছিলেন শুধু মেয়েরাই। তাঁদের মধ্যে ঠাকুর বাড়ির বাইরেরও দু-একজন ছিলেন। ১৮৯০ সালের অক্টোবরে রাজা ও রানীর যে-অভিনয় হয়, তাতে কেবল কমবয়সী। মেয়েরা নন, জ্ঞানদা দেবী এবং মৃণালিনী দেবীও অংশ নিয়েছিলেন। মোট কথা, অন্য বহু ব্যাপারের মতো ভদ্রঘরের মেয়েদের অভিনয়ে যোগ দেওয়ার ব্যাপারেও ঠাকুরবাড়ির পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলো। তখনোই ভদ্রঘরের মেয়েরা নাটক করতে এগিয়ে না-এলেও, ঠাকুরবাড়ির দৃষ্টান্ত সিকি-শতাব্দীর মধ্যে অন্য ভদ্রমহিলাদের অভিনয় করার প্রেরণা জুগিয়েছিলো।
ভদ্রঘরের মেয়েদের অভিনয়ে আনার ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির পরে যাঁর ভূমিকা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তিনি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়–সিনেমার জগতে সংক্ষেপে যিনি ডিজি নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও ঠাকুরবাড়ির সম্পর্ক ছিলো। তাঁর মেজভাই নগেন্দ্ৰনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জামাতা। তা ছাড়া, ধীরেন্দ্রনাথ নিজেও ঠাকুর পরিবারের এক আত্মীয়াকে বিয়ে করেছিলেন। এঁর নাম প্ৰেমিকা দেবী।
নির্বাক ছবি বিলেত ফেরতের জন্যে ধীরেন্দ্রনাথ অ্যাডভোকেট বিধুভুষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা সুশীলাকে নিয়ে এসেছিলেন। তা ছাড়া এনেছিলেন শ্ৰীীরামপুরের গোসাই পরিবারের একটি মেয়েকে। ভদ্রপরিবারের মেয়েদের জন্যে অভিনয় করা তখনো এতো নিষিদ্ধ ছিলো যে, গোসাঁই পরিবারের এই মেয়েটি প্রমীলা ছদ্মনামে অভিনয় করতে রাজি হন। ধীরেন্দ্রনাথ এর থেকেও সাহসী যে-পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা হলো: তিনি নিজের স্ত্রী প্ৰেমিকা দেবীকেও সিনেমায় অভিনয় করাতে রাজি করান। ১৯২১ সালে বিয়ের পর থেকে ১৯৩০ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রেমিকা দেবী বেশ কয়েটি ছবিতে অভিনয় করেন। তার প্রথম ছবির নাম ছিলো। ফ্লেইমস অব ফ্লেশ। আসল নাম প্রেমিকা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয় নাম হয়েছিলো প্রেমালতিকা। প্রেমিকা দেবী মারা যাওয়ার পর ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর দুই কন্যা পারুল এবং মণিকাকেও পর্দায় নিয়ে এসেছিলেন। মণিকার স্বামী পি গুহঠাকুরতা ছিলেন রীতিমতো গণ্যমান্য লোক। তিনিও তাঁকে অভিনয় করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথের আর-এক কৃতিত্ব তিনি কয়েকজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান তরুণীকে অভিনয় করতে রাজি করিয়েছিলেন। তারা সবাই বাংলা নামে পরিচিত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে নাম করেছিলেন সবিতা। বাংলায় কবিতা লিখতেন। তিনি এবং বাঙালি বলে নিজের পরিচয় দিতেন।
ভদ্রঘরের তরুণীদের অভিনয়ের জগতে আনার ভূমিকা শিশিরকুমার ভাদুড়ীও পালন করেছিলেন। তিনি যাদের রাজি করিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন দুই বোন–কঙ্কাবতী এবং চন্দ্রাবতী। তারা ছিলেন এক ব্ৰাহ্ম জমিদার এবং অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের কন্ন্যা এবং জন্মেছিলেন মুজাফফরপুরে। কঙ্কাবতী বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথের কাছে তার অভিনয়ের হাতেখড়ি হয়েছিলো। ১৯২৮ সালে পঁচিশ বছর বয়সে তিনি শিশির ভাদুড়ীর আমন্ত্রণে মঞ্চে প্ৰবেশ করেন। পরে তাঁর সঙ্গে নিউ ইয়র্কে গিয়ে অভিনয় করেছিলেন। চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। চন্দ্রাবতী ছিলেন কঙ্কাবতীর চেয়ে ছ। বছরের ছোটো। তিনিও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবং দীনেন্দ্রনাথের কাছে গান শিখেছিলেন। ১৯২৯ সালে নির্বাক চলচ্চিত্রে তিনি প্ৰথম আত্মপ্ৰকাশ করেন। পরে তিনি বহু নাম-করা ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৪০-এর দশকে তিনি তিনবার শ্ৰেষ্ঠ অভিনেত্রী হিশেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন।