দেবতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিলো, তাঁর কণ্ঠ থেকেই সেটা টের পেলাম। কিন্তু পর মুহূর্তেই একটু থেমে দয়াময় এবং ক্ষমাশীল দেবতা তাঁর কণ্ঠ সংযত এবং নিচু করে বললেন, “তুমি একটি বলদ নয়তো গরুর পক্ষ লইয়া এই সকল কুযুক্তি দিতে না। গরুর চক্ষু দুইটি সুন্দর–এই পর্যন্ত। কিন্তু নারীদের কেবল নয়ন দুটি সুন্দর নয়। এমন মায়া দিয়া তাঁহাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃজন করা হইয়াছে যে, তাহাদের অতীব মনোহর দেহের দিকে তোমরা বেহারার মতো চাহিয়া থাকো। শত আবরণে নিজেদের দেহ ঢাকিয়াও নারীরা তোমাদের লুব্ধ দৃষ্টি হইতে নিজেদের বাঁচাইতে পারে না। তোমাদের নির্লজ্জ এবং লালসার দৃষ্টি তাহাদের পুরু বস্ত্ৰ ভেদ করিয়া ধারালো তিরের মতো তাহাদের দেহে বিধিতে থাকে। লুকাইয়া লুকাইয়া এবং তির্যক দৃষ্টিতে প্রতিদিন নারীদের না-দেখিলে তোমাদের ভীত হজম হয় না। সেই নারীদের সম্পর্কে তোমাদের এতো অশ্রদ্ধা! বৎস! সত্য করিয়া বলো: কোনো গরুর সহিত শয়ন করিয়াছ? অপর পক্ষে, নারীদের সহিত প্রতিদিন শয়ন করিয়া স্বৰ্গসুখে উন্মত্ত হইয়া তাহাদের দেহ মন্থন করিয়া স্বাৰ্থপরের মতো নিজেদের যৌনক্ষুধা মিটাইয়া থাকো। তাহাদের ক্ষুধা মিটিল। কিনা, তাহার কথা ভাবিয়াও দেখো না। সঙ্গম সারিয়া তোমরা বজুনিৰ্ঘোষে নাক ডাকাইতে আরম্ভ করো। আর নারী পরবর্তী ন মাস তোমার সন্তান গর্ভে ধারণ করিয়া কতো না ক্লেশ স্বীকার করে! তারপরও সেই নারীদের তোমরা গরুর চাইতেও হেয় জ্ঞান করে! তোমরা এতো নিকৃষ্ট জীব!”
শেষের কথাটা দেবতা সঠিক বলিয়াছেন বলিয়া বোধ হইলো। কিন্তু প্রতিবাদ না-করলে নারীরা পাছে আশকারা পায়, সেই হেতু হাত কচলে এবং যাদুর সম্ভব ছদ্মবিনয়ে বিগলিত হয়ে দেবতাকে আবার বললাম, হে দেব! নারীদের আমরা পূজা করিনে বটে, কিন্তু তাই বলে তাদের গরুর চেয়ে কম যত্ন করি, এই অভিযোগ সম্ভবত ন্যায্য নয়। বৈষম্যের একটা সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত দিয়ে বিষয়টার পুনর্বিবেচনা প্রার্থনীয়।
দিব্যজ্যোতি প্ৰসন্নবদন শান্তকণ্ঠ দেবতা। হঠাৎ রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “তুমি তো বাপু মহা ফাজিল! মুখে মুখে তর্ক করিতেছ? বৈষম্যের সব চাইতে বড়ো দৃষ্টান্ত হইল তোমরা নারীদের নিজেদের মতো মানুষ বলিয়াই গণ্য করো না। তোমরা তাহাদের যতো দূর সম্ভব শোষণ এবং ব্যবহার করো। কিন্তু তাহার পর তাহাদের একটা জন্তুর মতোও খাতির করো না। যেমন, গরুকে যত্নের সঙ্গে ঘাস খাওয়াও। খড়, জাবনা, খৈল এবং ফেন দেও। কিন্তু নারীদের কখনো নিজ হাতে কোনো খাবার পরিবেশন করিয়া খাওয়াইয়াছ? তোমরা নিজেরা গোগ্রাসে উদরপূর্ণ করিয়া শয্যায় আশ্রয় লও, কিন্তু যে-নারী তোমাদের আহার প্রস্তুত করিয়াছে, তাহারা খাইল কিনা অথবা কি খাইল কখনো খবর লইয়াছ? আমার মেজাজ খারাপ করিয়া দিও না, শেষে মুখে অভিশাপ বাক্য আসিয়া পড়িতে পারে। তাহা না-চাহিলে বুদ্ধিমানের মতো মৌন অবলম্বন করো।”
তোশামদ করে বললাম, হে মহাদেব! আমাকে শেষ কথা বলতে দেওয়ার নিবেদন মঞ্জুর করুন। দেবতা ক্ষণিকের জন্য নীরবে থেকে বললেন, “ঝটপট বলিয়া ফেলো!” আমি বললাম, “হে মহাদেব, গরুর এমন কিছু নেই, যা কাজে লাগে না। কিন্তু নারীরা বহু অনর্থের হেতু। বিশেষ করে তাদের নিয়ে পুরুষে পুরুষে প্রায়শ লড়াই লাগে। মুশকিল এই যে পীস কীপিং ফোর্স দিয়ে এ ধরনের লড়াই বন্ধ করা যায় না। শাস্ত্রে আপনারা বলেছেন, নারী নরকের দ্বার। পথে নারী বিবর্জিতা। নারীর কাম পুরুষের অষ্ট গুণ। কতো কি! তা ছাড়া, নারীরা মাঝে মধ্যে মশারির ভেতরে থেকে বক্তৃতা করে–ইংরেজিতে একে কার্টেন লেকচার বলে। এই বক্তৃতা শাস্ত্র বিষয়ক সেমিনারের চেয়েও বিরক্তিকর। হে দেব, গরুকে নিয়ে এসব ঝামেলা মোটেই সহ্য করতে হয় না। গরুচাের গরুর প্রতি লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় বটে, কিন্তু গরুকে নিয়ে ডুয়েল লড়ার কোনো কাহিনী শোনা যায় না। অতএব গরুকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। কিনা, আপনিই ন্যায় বিচার করে রায় দিন।”
দেবতার প্রসন্নবদন আকস্মিকভাবে কুৎসিত আকার ধারণ করলো। বুঝলাম তিনি খুবই চটে গেছেন। তিনি প্ৰায় ভেঙচি দিয়ে বললেন, “তুমি অতীব বেহায়া। তিল মাত্র চক্ষুলজ্জা নাই। তাই এই রূপ বলিতেছ। নারীদের কী উদ্দেশে আমরা সৃষ্টি করিয়াছিলাম, আর তোমরা কিভাবে তাহাদের ভালোমন্দ উভয় কাজে সারাক্ষণই ব্যবহার করিতেছ! ধিক তোমাদের।”
আমার মুখ দিয়ে অনিচ্ছায় অস্ফুট এবং দুর্বোধ্য একটা শব্দ বেরিয়ে গেলো। দেবতা আরও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললেন, “চুপ রও শয়তান!! নারীদের তোমরা চরম অপব্যবহার করিতেছ। তুমি গবেট এবং কুতর্কবাগীশ। তথাপি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।–নারীদের কখনো শ্মশ্রু হইতে দেখিয়াছ? নিষেধ করিতেছি— মুখ খুলিও না। তাঁহাদের কদাপি শ্মশ্রু হয় না। তথাপি ক্ষৌরিকর্মের বিজ্ঞাপনেও তাঁহাদের চিত্ৰই ব্যবহার করো। কৌটোর দুধ সাধারণত গরুর দুধ। কিন্তু তাহার বিজ্ঞাপনেও তোমরা নারীদের টানাটানি করো। নারী না-হইলে তোমাদের অশন, বসন, শয়ন, স্বপন–কিছুই হয় না। আবোল-তাবোল অর্থহীন কবিতা লিখিতেও নারীকে টানিয়া আনো। কেবল ঐড়ে তর্ক করিবার সময়ে নারীর তুলনায় গরুকে সেরা বলো। তোমরা পুরুষরা মহাভণ্ড এবং জীবজগতের কুলাঙ্গার। মহাদেব অচিরেই নারীদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া নারীবাদী নামক এক দল নারীবেশী পুরুষহন্তা পাঠাইবেন। তাঁহারা তাবৎ নারীবিদ্বেষী পুরুষদের নাশ করিয়া বিশ্বে শান্তি এবং সাম্য ফিরাইয়া আনিবেন। মনে রাখিও, শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর! যদি বিনাশ হইতে বঁচিবার কিছুমাত্র বাসনা থাকে, তাহা হইলে এই দণ্ডে নাকে খত দিয়া নারীদের নিকট অতীতের সমস্ত অবিচার এবং অত্যাচারের জন্য জোড়হস্ত করিয়া আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আশ্বাস দিয়া বলিতে পারি, সেই নারী-বিপ্লবের পর অনন্ত কাল ধরিয়া বিশ্বে অসীম আনন্দের ধারা বহিতে থাকিবে।”