নরীসুন্দরীর সমবয়সী ছিলেন তারাসুন্দরী। তিনিও বারবণিতার সন্তান। ১৮৮৪ সালে বছর সাতেক বয়সে তিনি বিনোদিনীর সাহায্যে স্টার থিয়েটারের মঞ্চে প্রবেশ করেন। গিরিশ ঘোষের চৈতন্যলীলা নাটকে বিনোদিনী নিমাই-এর ভূমিকায় অভিনয় করতেন। তারাসুন্দরী সেই নাটকেই একটি ছেলের ভূমিকায় নামেন। তিনি গিরিশ ঘোষের আরও কয়েকটি নাটকে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম বালিকা চরিত্রে অভিনয় করেন হারানিধি নাটকে। ১৮৯১ থেকে তিনি অভিনয় করতেন নায়িকার ভূমিকায়। তবে তাঁর খ্যাতি আসে ১৮৯৪ সালে চন্দ্ৰশেখর নাটকে শৈবলিনীর ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। অভিনয়ে তিনি এতো পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন যে, এক সময়ে সবাই তাকে বলতেন নাট্যসমাজ্ঞী।
স্টারের পর ১৮৯৭ সাল থেকে তারাসুন্দরী ক্লাসিক থিয়েটারে প্রধান অভিনেত্রীতে পরিণত হন। প্রথমে অমৃতলাল মিত্রের কাছে অভিনয় শিখলেও, ক্লাসিকে এসে তিনি অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সাহচর্যে অভিনয়ে রীতিমতো পরিণতি লাভ করেন। এখানে তিনি অনেকগুলো নাটকের নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং তাঁর খ্যাতি দীর্ঘস্থায়ী হয়। ১৯২২ সাল পর্যন্ত তিনি থিয়েটারের জগতে নিয়মিত কাজ করেছেন। কিন্তু একবার অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরও শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন জনা এবং রিজিয়ার ভূমিকায়। তাঁর সে অভিনয় কিংবদন্তীতে পরিণত হয়। অভিনয় ছাড়া তারাসুন্দরী গল্প-কবিতাও লিখতেন বিনোদিনীর মতো।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনিও তাঁর পূর্ববর্তী অভিনেত্রীদের মতো একাধিক ‘বাবুর রক্ষিতা ছিলেন। যিনি নাটকের জগতে ছিলেন অমন সম্মানের পাত্রী, ব্যক্তিগত জীবনে তিনিই সম্মান, সম্রাম অথবা স্বীকৃতি পাননি, অথবা বলা যেতে পারে, সামান্যই পেয়েছিলেন। যে-পুরুষসমাজ ভেঙে পড়তো তাঁর অভিনয় দেখতে, সেই পুরুষসমাজই ব্যক্তি তারাসুন্দরীকে শ্রদ্ধা দূরে থাক, সাধারণ স্বীকৃতি দিতেও তৈরি ছিল না।
তিনকড়ি, নরীসুন্দরী, তারাসুন্দরীদের যুগের আরও একজন সুপরিচিত অভিনেত্রী ছিলেন নীরদাসুন্দরী। তাঁর জন্ম বস্তিতে, মা কাজ করতেন ঝিয়ের। নীহারবালা, প্ৰভা দেবী, রমা বসু ইত্যাদি সবারই পরিচয় ছিলো কমবেশি একই রকমের।
মোট কথা, বাংলা থিয়েটারের আদি যুগের নাম-করা অভিনেত্রীরা সবাই এসেছিলেন বারবণিতাদের ঘর থেকে, অথবা সমাজের একেবারে নিচের তলা থেকে। কেউ কেউ অভিনেত্রী হয়ে নিজেরা বারনারী হয়েছিলেন। এরা সবাই কমবেশি গান জানতেন। নাচও জানতেন বেশির ভাগই। এমন কি, অল্পবিস্তর লেখাপড়াও তাঁরা শিখেছিলেন। প্রধানত দারিদ্র্যের কারণে তারা অভিনয়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ এসেছিলেন পতিতাবৃত্তি থেকে রক্ষা পেতে, অথবা আর-একটু সম্মানজনক কাজের জন্যে। সুকুমারী, বিনোদিনী, তিনকড়ি, তারাসুন্দরী প্রমুখ অভিনেত্রী তা পেয়েওছিলেন। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, একবার রূপজীবিনীর ভূমিকা ত্যাগ করার পর তাঁরা বৃহত্তর সমাজে গৃহীত হয়েছিলেন অথবা বিয়ে-থা করে সংসার করেছিলেন। বরং দেখতে পাই, তারা অভিনয় থেকে অর্থকড়ি উপার্জন করলেও সমাজে টিকে থাকার জন্যেই কারো না কারো রক্ষিতায় পরিণত হয়েছিলেন। নিজেরা গ্রানির মধ্যে থেকেও অন্যদের আনন্দ দিয়েছেন। দেহ এবং রূপ দিয়ে উপার্জন করার পাপবোধ থেকে শেষ বয়সে এই খারাপ মেয়েমানুষরা’ ধর্মের দিকেও একটু বেশি করেই বুকে পড়তেন। কেউ কেউ দারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে ভিক্ষা করেও জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছেন।
আমরা পরের আলোচনা থেকে দেখবো বাংলা রঙ্গমঞ্চের আদি পর্ব শেষ হবার অনেক কাল পরেও অভিনেত্রীরা আসতেন সমাজের নিচের তলা থেকে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ–যারা অভিনয় করতেন সমাজ তাদের গণ্য করতো দেহজীবী বলে। তাদের অভিনয় এবং রূপের প্রশংসা হলো পত্রপত্রিকায় এবং বাড়িতে বাড়িতে, কিন্তু ব্যক্তি হিশেবে তাঁরা বিবেচিত হতেন। কুলটা নারী বলে। এই অভিনেত্রীদের সমাজের অভিজাতরা কতোটা ঘূণা করতেন, তা বোঝা যায় হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের একটি গল্প থেকে। তাকে নাকি এক পথচারী থিয়েটারের পথ জিজ্ঞেস করেছিলেন। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সে পথ চেনেন না। কিন্তু একটু পরে তাঁর যখন মনে হলো যে, পথ চিনেও চেনেন না বলায় সেটা মিথ্যে বলা হলো, তখন তিনি ফিরে গিয়ে সেই পথচারীকে বললেন যে, তিনি পথ চেনেন, কিন্তু বলবেন না। তিনি ব্ৰাহ্ম ছিলেন। এবং তার রুচিও ছিলো ষোলো আনা ব্ৰাহ্ম অথবা পিউরিটানা-রুচি। এতোটা নাহলেও বিশ শতকে এসেও অনেকে তারই মতো থিয়েটারকে অপবিত্র জায়গা বলে বিবেচনা করতেন, অভিনেত্রীদের কারণে।
বাইরের নারীদের নিয়ে ফুর্তি করলেও ঘরের নারীদের সে যুগের পুরুষরা মঞ্চে নিয়ে আসা দূরে থাক, মঞ্চে আনার কথা ভাবেনওনি। সমাজকে চটিয়ে দিয়ে এ রকম পদক্ষেপ নেওয়ার সাহসই কারো ছিলো না। বস্তৃত, আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি, অভিনেত্রীদের রক্ষিতা রাখলে সমাজ তা মেনে নিতো; কিন্তু অভিনেত্রীদের বিয়ে করলে সমাজ-সংসার তা স্বীকার করে নিতো না। সমাজের এই তীব্র নিষেধ অমান্য করে বাড়ির বউ অথবা কন্যাদের অভিনয়ে আসার জন্যে উৎসাহ দিয়েছিলো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। ১৮৮১ সালে এই পরিবার এ রকমের দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলো প্রধানত একাধিক কারণে। সমাজে এ পরিবারের যে-স্থান ছিলো, তাতে তাঁরা সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন। ধর্ম বিশ্বাসের দিক থেকেও এঁরা ছিলেন মূলধারা হিন্দুদের থেকে খানিকটা আলাদা এবং অনেকটাই প্রগতিশীল। সর্বোপরি, যে-মঞ্চে এই মহিলারা অভিনয় করেছিলেন, তা ছিলো তাদের বাড়ির মঞ্চ। সে মঞ্চ সাধারণ মানুষের জন্যে খোলা ছিলো না।