৫০টিরও বেশি নাটকে প্রায় ৯০টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী। তার মধ্যে পৌরাণিক এবং ধর্মীয় নাটকে তাঁর অভিনয় ছিলো বিশেষ করে স্মরণীয়। এসব অভিনয় কেবল রক্ষণশীল হিন্দুরা দেখেননি, বরং তাঁরা উপভোগও করেছিলেন। এভাবে বিনোদিনী মহিলাদের অভিনয়কে বাঙালি দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। অভিনয় ছাড়া গানেও তাঁর অবদান কম নয়। বিশ শতকের গোড়ায় যখন বঙ্গদেশে গ্রামোফোন চালু হয়, তখন তিনি এগিয়ে আসেন গান গাইবার জন্যে। তার রেকর্ড করা অনেকগুলোর গানের মধ্যে কয়েকটি রক্ষা পেয়েছে। এ গান থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, তিনি কতো উচুমানের গায়িকা ছিলেন।
ব্যক্তি বিনোদিনীর নামে-মাত্র বিয়ে হয়েছিলো তাঁর বয়স যখন বছর পাঁচেক। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। সে স্বামীর সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিলো না। পরে তিনি একেএকে তিনজন ধনীর রক্ষিতা হন। এর মধ্যে শেষজনের সঙ্গে তার কেটেছে একত্রিশ বছর। তিনি বিনোদিনীর জন্যে বাড়িসহ কিছু সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। সেই দিয়েই জীবনের শেষ ২৯ বছর বেঁচে ছিলেন। নয়তো তার অবস্থা হতো পারতো সুকুমারীর মতো নিঃস্ব, রিক্ত। শেষ জীবনে সুকুমারী কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন, কেউ তার খোজ রাখে না। কিন্তু বিনোদিনী শেষ পর্যন্ত সচ্ছল অবস্থায় থেকে বিদায় নিতে পেরেছিলেন। ১৯৪১ সালে।
বিনোদিনীর বছর পাচেকের ছোটো ছিলেন। কিরণবালা। তিনিও জন্মেছিলেন। কলকাতায় নিষিদ্ধ পাড়ায় এক বারবণিতার ঘরে। তাঁর পিতৃপরিচয় জানা যায় না। কখন থেকে তিনি অভিনয় শুরু করেন তাও নয়। তবে বিনোদিনীর সঙ্গে স্টার থিয়েটারে অভিনয় করার সময় থেকে তিনি পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। গিরিশ ঘোষই তাঁকে অভিনয় করতে শিখিয়েছিলেন। যতোদিন বিনোদিনী স্টারে ছিলেন, ততোদিন নিজের যোগ্যতার কারণেই তিনি সব সময়ে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। কিন্তু ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিনোদিনী যখন মঞ্চ ছেড়ে স্থায়ীভাবে রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হন, তখন যেসব ভূমিকায় তিনি অভিনয়। করতেন, সেসব ভূমিকায় নামেন কিরণবালা। এসব চরিত্রে অভিনয়ে বিনোদিনী যেআদর্শ রেখে গিয়েছিলেন, কিরণবালা তা যোগ্যতার সঙ্গে বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এ দিয়ে প্রমাণিত হয় যে, অত্যন্ত উঁচুদরের অভিনয় ক্ষমতা ছিলো তাঁর। তবে তা সত্ত্বেও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে তিনি যে খুব বড়ো নায়িকা হিশেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে পারেননি, তার কারণ তাঁর অকাল মৃত্যু। মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি বসন্ত রোগে মারা যান।
বিনোদিনীর পরে সে যুগের সবচেয়ে নাম-করা অভিনেত্রী ছিলেন তিনকড়ি দাসী। তারও মা ছিলেন বারবণিতা। তিনিও অভিনয়ের দিকে এসেছিলেন টাকার অভাবে। পরবর্তী কালে যিনি এতো বড়ো অভিনেত্রী হয়েছিলেন, ১৮৮৬ সালের জুন মাসে তিনি যখন গিরিশ ঘোষের বিম্বমঙ্গল নাটকে অভিনয় আরম্ভ করেন, তখন সে ভূমিকা ছিলো নির্বােক সখীর। সত্যিকারভাবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। মীরাবাঈ নাটকে, মীরার ভূমিকায়। বিনোদিনীর মতো তিনিও ভালো অভিনয় শিখেছিলেন গিরিশ ঘোষের কাছে। ১৮৯৩ সালে তারই নাটক ম্যাকবেথে লেভী ম্যাকবেথের ভূমিকায় অভিনয় করে তিনকড়ি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ান। গিরিশ ঘোষের আরও কয়েকটি নাটকে তিনি প্রধান ভূমিকায় নেমেছিলেন। তাঁর অভিনয় পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন যে, বাংলার রঙ্গমঞ্চে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। আসলে অভিনয়ে তাঁর আকর্ষণ এতো আন্তরিক ছিলো যে, তিনি এর জন্যে অন্য লোভ ত্যাগ করেছিলেন। যেমন, প্রথম দিকে তাঁকে মাসে দু শো টাকা দিয়ে একজন ধনী রক্ষিতা রাখতে চাইলেও তিনি চল্লিশ টাকা বেতনের অভিনেত্রীর কাজ ছাড়তে রাজি হননি। দুশো টাকা তখন অনেক টাকা। স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করায় তাঁর মা তাঁকে প্রহার করেছিলেন। টাকার প্রতি তাঁর মমতা বস্তৃত কমই ছিলো। তাই ১৯১৭ সালে মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর দুটি বাড়ি হাসপাতালের জন্যে দান করে গিয়েছিলেন।
থিয়েটারে কাজ শুরু করার পর একাধিক পুরুষের সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের সম্পর্ক হয়েছিলো। এমন কি, স্বয়ং গিরিশ ঘোষের সঙ্গেও তার প্রণয় ছিলো বলে লোকজন বলতো। তবে জীবনের শেষ দিকের বছর বিশেক তিনি এক বাবুর রক্ষিতা ছিলেন। নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই বাবু তাঁকে যত্নের সঙ্গেই রেখেছিলেন বলে মনে হয়। তিনকড়ি তাঁর তৃতীয় বাড়িটি দান করে গিয়েছিলেন এই বাবুর পুত্ৰকে।
তিনকড়ির কয়েক বছরের ছোটো ছিলেন কুসুমকুমারী (১৮৭৬৫-১৯৪৮)। নাচের পথ ধরে মিনার্ভা থিয়েটারে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। তারপর গ্র্যান্ড, ক্লাসিক, কোহিনুর, স্টার ইত্যাদি অনেক থিয়েটারেই যোগ্যতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। আলিবাবা নাটকে মার্জিনার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো। তিনিই প্ৰথম অভিনেত্রী যিনি অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের নাচ শেখাতেন। ভালো গানও জানতেন তিনি।
কুসুমকুমারীর মোটামুটি একই বয়সী ছিলেন নরীসুন্দরী। তিনিও তাঁর আগেকার অভিনেত্রীদের মতো বারবণিতার সন্তান ছিলেন। সঙ্গীতশিল্পী হিশেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। অন্যদের তুলনায় একটু বেশি বয়সে–প্রায় ষোলো-সতেরো বছর বয়সে— ১৮৯২ সালে তিনি স্টার থিয়েটারের মঞ্চে উঠেছিলেন–ঋষ্যশৃঙ্গ নাটকের প্রধান চরিত্রে। বছর দুয়েক পরে চন্দ্ৰশেখর নাটকে তিনি দলনীর ভূমিকায় সত্যিকার খ্যাতি লাভ করেন। তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নানা চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে স্থায়ী নাম রেখে গেছেন। ১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা স্টারের অভিনেত্রী ছিলেন। তারপর কখনো মির্নাভা, কখনো স্টার, কখনো অন্য কোনো থিয়েটারে কাজ করে শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালে মঞ্চ থেকে সরে যান। তিনি মারা যান ১৯৩৯ সালে।