গোলাপসুন্দরী বেশ খ্যাতি লাভ করলেও বাংলা রঙ্গমঞ্চের আদিপর্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন বিনোদিনী। সুকুমারীর সঙ্গে একত্রে তিনি কিছুকাল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে কাজ করেছেন। দিদি ডাকতেন তাঁকে। অভিনয় ছাড়া তিনি খুব ভালো গান জানতেন। তদুপরি, তাঁর যথেষ্ট সাহিত্যিক গুণও ছিলো। বাঙালি মহিলারা যেসব আত্মজীবনী লিখেছিলেন, তাদের মধ্যে বিনোদিনীর ‘আমার কথা’ সত্যকথন এবং ভাষার সরলতার জন্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্য পুরুষ চরিত্র বিশ্লেষণেও। আত্মজীবনী ছাড়া তিনি কিছু কবিতাও প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্ৰৌপদীর সখীর ভূমিকায় প্রথমবারের মতো মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্ৰ তেরো-চোদ্দো বছর। বেতন ঠিক হয় দশ টাকা। তাঁর বংশ পরিচয় সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে তিনি সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে মনে করার কারণ নেই। তাদের বাড়ির খোলাঘরে যেসব ভাড়াটে ছিলেন, তারা স্বামীস্ট্রীর মতো থাকলেও বিবাহিত ছিলেন না–বিনোদিনী নিজেই আত্মজীবনীতে এ কথা লিখেছেন। তা ছাড়া, নিজেকে তিনি সবিনয়ে অনেকবারই বারনারী ও বারাঙ্গনা বলেছেন।
অল্পকালের মধ্যে এই থিয়েটারের সঙ্গে তিনি উত্তর ভারতের বহু জায়গায় ভ্ৰমণ করেন। দুবছর পরে তিনি ন মাসের জন্যে বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু গিরিশ ঘোষের কথায় তিনি ১৮৭৭ সালে সেপ্টেম্বরে বেঙ্গল ছেড়ে ন্যাশনাল থিয়েটারে ফিরে আসেন। গিরিশ ঘোষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তার নিজের জন্যে খুবই কাজে লেগেছিলো, কারণ গিরিশই তাকে উন্নত মানের অভিনয় শিক্ষা দিয়েছিলেন। গিরিশকে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে গুরু এবং দেবতা বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই দেবতা যে কতোটা স্বার্থপর ছিলেন এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বিনোদিনীকে কতোটা ব্যবহার করেছিলেন, পরের ঘটনাবলী থেকে সেটা গোপন থাকে না।
১৮৮৩ সালের গোড়ার দিকে বিনোদিনীকে নিয়ে গিরিশ ঘোষ স্টার থিয়েটার গড়ে তুলেছিলেন। এই থিয়েটার করার ব্যাপারে তাঁদের আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী— গুরমুখরায়। আসলে থিয়েটার নয়, এই ভদ্রলোকের লক্ষ্য ছিলো বিনোদিনীকে পাওয়া। বারবণিতা ছিলেন বটে, তবু বিনোদিনীর পক্ষে গুরমুখরায়ের কাছে নিজেকে তুলে দেওয়া সহজ ছিলো না। কারণ তার আগে থেকেই তিনি একজন ধনী জমিদারের রক্ষিতা ছিলেন। তাকে আন্তরিকভাবে ভালোওবাসতেন তিনি। আর এই জমিদারও তাঁকে নিজের প্রেমিকা বলে গণ্য করতেন। বিনোদিনী অভিনয় করবেন–এতে তাঁর আপত্তি ছিলো না। বাধা দেখা দেয়। অন্য দিক থেকে। গিরিশ ঘোষ এবং বিনোদিনী যে-ন্যাশনাল থিয়েটারে কাজ করতেন, তার মালিক ছিলেন প্রতাপচাদ জহুরী নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ী। শখ হিশেবে নয়, থিয়েটারকে তিনি ব্যবসা হিশেবেই দেখতেন। তাঁর অধীনে স্বাধীনভাবে কাজ করা গিরিশ ঘোষ এবং তার সহযোগী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন গিরিশ ঘোষ একটি নতুন থিয়েটার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
থিয়েটার গড়ে তোলার জন্যে যে-টাকা পয়সার দরকার ছিলো, তা গিরিশ জোগাড় করতে পারেননি। সেই পরিস্থিতিতে বিশ-একুশ বছরের যুবক গুরমুখরায় থিয়েটার গঠনে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসেন। আগেই বলেছি, থিয়েটারের চেয়ে বিনোদিনীর দিকেই ছিলো তার বেশি আকর্ষণ। তিনি তাই বিনোদিনীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ দিয়ে তাকে থিয়েটার গঠনের উদ্যোগ ছেড়ে দেওয়ার জন্যেও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু থিয়েটার ছিলো বিনোদিনীর প্রাণ। একমাত্র থিয়েটার গঠনের শর্তেই তিনি নিজের প্রেমিককে ত্যাগ করে গুরমুখরায়কে গ্রহণ করতে রাজি হন। ওদিকে, তার প্রেমিক-জমিদার। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন। লাঠিয়াল নিয়ে এসে নতুন থিয়েটার ভেঙে ফেলতেও চেষ্টা করেন। তিনি। সাময়িকভাবে আত্মগোপন করেও বিনোদিনী তার হাত থেকে রক্ষা পাননি। একদিন তলোয়ার হাতে জমিদার ঢুকে পড়েন বিনোদিনীর শোবার ঘরে। খুন করার জন্যে চেষ্টাও করেন। কিন্তু ভাগ্য এবং উপস্থিত বুদ্ধির জোরে বিনোদিনী তলোয়ারের কোপ থেকে রক্ষা পান। বস্তৃত, তিনি থিয়েটার গড়ে তোলার জন্যে যে-আত্মত্যাগ স্বীকার করেছিলেন তা অতি অসাধারণ। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, এই বিরাট আত্মত্যাগ সত্ত্বেও কারো কারো বিরোধিতার কারণে স্টারে তিনি সাড়ে তিন বছরও কাজ করতে পারেননি। গুরমুখরায়ও তাকে সমর্থন দিতে পারেননি। কারণ থিয়েটার শুরু করার পর তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র বছরখানেক। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার তাঁকে যারা সরিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে গিরিশ ঘোষও ছিলেন।
স্টার থিয়েটারে অভিনয়ের সময়েই তিনি খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিলেন। একশো বছর পরেও তাঁর নাম টিকে আছে, যদিও মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সে তিনি অবসর নিতে বাধ্য হন। সন্দেহ হয়, তিনি যখন অবসর নেন, তখনো তার প্রতিভার চরম বিকাশ হয়েছিলো কিনা।
স্টারের আমলে গিরিশ ঘোষ পুরোদমে নাটক লিখতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি পৌরাণিক এবং ধর্মীয় নাটকসহ বিভিন্ন ধরনের নাটকই লিখেছিলেন। এমন কি, শেক্সপীয়রের অনুবাদও শুরু করেছিলেন। এই থিয়েটার স্থাপিত হওয়ার পর বছর দুই পরে তাঁর লেখা চৈতন্যলীলা নাটকে চৈতন্যের ভূমিকায় নেমেছিলেন বিনোদিনী। ১৮৮৫ সালের ৭ই অক্টোবর সেই নাটকের অভিনয় দেখতে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। তিনি তার ভাববিহবল অসাধারণ অভিনয় দেখে এতো মুগ্ধ হন যে, অভিনয় শেষ হবার পর তাঁকে আশীৰ্বাদ করে যান। যে-কালে বিদ্যাসাগর মঞ্চে নারীদের আগমনে অভিনয় দেখাই বন্ধ করেছিলেন, সেই সময়ে রামকৃষ্ণের মতো একজন ধর্মগুরু। তাঁর অভিনয় দেখায় এবং তাকে আশীৰ্বাদ করায় মঞ্চে মেয়েদের অভিনয় হিন্দু সমাজের এক ধরনের স্বীকৃতি লাভ করেছিলো। এর পরেও রামকৃষ্ণ দুবার স্টারে অভিনয় দেখতে এসেছিলেন। নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখনো স্বামী বিবেকানন্দ হননি। কিন্তু তিনিও একাধিকবার স্টারে অভিনয় দেখতে আসেন। আর আসেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নিজের লেখা মৃণালিনীর অভিনয় তিনি দেখেছিলেন ১৮৮৫ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে। সেই নাটকের মনোরমার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিনোদিনী। এই অভিনয় দেখে বঙ্কিমচন্দ্ৰ মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি মনোরমার চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন কাগজে-কলমে। কিন্তু সেই মনোরমাকে তিনি যে নিজের চোখের সামনে দেখতে পাবেন এটা আশা করেননি। বিনোদিনী আসলে মনোরমাকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।