একটি পত্রিকা বেঙ্গল থিয়েটারের সমালোচনা করে বলেছিলো যে, এঁরা “বেশ্যা”দের মঞ্চে এনে নাটককে যাত্রার স্তরে নামিয়েছেন। তার মানে তখন নাটক এবং যাত্রারও বড়ো রকমের পার্থক্য ছিলো। নাটক ছিলো শিক্ষিত ভদ্রলোকদের, ধনী বাবুদের। আর, যাত্রা ছিলো সাধারণ মানুষদের। আশা করা হতো পাশ্চাত্য প্রভাবিত নাটকের রুচি হবে যাত্রার চেয়ে উন্নত মানের। ভদ্রলোকদের মঞ্চে তাই অভিনেত্রীদের ডাক পড়েনি। কিন্তু যাত্রায় তারা অংশ নিতেন। সমাজের এই মূল্যবোধকে প্রশ্ন করে অভিনেত্রীদের নিয়ে এসে শরৎচন্দ্র ঘোষ যে-ভূমিকা পালন করেছিলেন তা কতো গুরুত্বপূর্ণ এবং যে-সৎসাহস দেখিয়েছিলেন, তা কতো অসাধারণ, তা বোঝা যায় আরও ৪০ বছর পরের একটি ঘটনা থেকে। ১৯১৩ সালে যখন দাদাসােহবে ফালকে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখনো নায়িকার ভূমিকায় তাঁকে নিতে হয়েছিলো রেস্টুরেন্টের এক পুরুষ রাধুনিকে। আর, ঢাকায় পূর্ববঙ্গ সরকার ১৯৫৮ সালেও ‘বেদের মেয়ে’ নাটক করার অনুমতি দিয়েছিলো। এই শর্তে যে, তাতে কোনো মহিলা অভিনয় করতে পারবেন না। এ দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎচন্দ্র ঘোষ রীতিমতো ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তবে স্বীকার না-করে উপায় নেই যে, ১৮৭২ সালে সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হওয়ার পর নারীচরিত্রে মহিলাদের অভিনয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিলো। আগে হোক পরে হোক, মহিলারা আসতেনই! তাই একবার সমাজের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে শরৎচন্দ্র মহিলাদের মঞ্চে নিয়ে আসার পর অন্য সব থিয়েটারই তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছিলো। এমন কি, ১৮৮০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের উদ্যোগে তাদের বাড়ির নিজস্ব মঞ্চে যেসব অভিনয় হয়, তাতেও পরিবারের মহিলারা অংশ গ্রহণ করেন, যদিও সাধারণ রঙ্গমঞ্চে “ভদ্রমহিলাদের” অভিনয় পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেও হয়নি।
মহিলারা অভিনয় করার শিক্ষা সেকালে পাননি, কিন্তু তাদের অনেকের যে অভিনয় করার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিলো, তা অচিরেই প্রমাণিত হয়। বেঙ্গলের দ্বিতীয় অভিনয়ে–২৩শে আগস্ট ১৮৭৩ তারিখে–যোগ দিয়েছিলেন গোলাপসুন্দরী। তিনি ভালো গান জানতেন, বিশেষ করে কীর্তন গান। তা ছাড়া, অল্পকালের মধ্যেই অভিনয়ে বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। নানা ধরনের ভূমিকায় খ্যাতির সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। তিনি। বেঙ্গল থিয়েটারে তখন কাজ করতেন সেকালের বিখ্যাত অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী। তিনি গোলাপসুন্দরীকে অভিনয় শিখিয়ে ভালো অভিনেত্রীতে পরিণত করেন।
গোলাপ যেসব নাটকে অংশ নেন, তার মধ্যে একটি ছিলো গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে উপেন্দ্রনাথ দাসের শরৎ-সরোজিনী। ১৮৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে অভিনীত এই নাটকে তিনি সুকুমারী নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তার অভিনয় এতো সুন্দর হয়েছিলো যে, দর্শকরা তাঁর নামই দেন সুকুমারী। অতঃপর এই নামেই তিনি বেশি পূরিচিত হয়েছিলেন। উপেন্দ্রনাথ দাস তখন এই থিয়েটারের পরিচালক ছিলেন। তখন সেখানে গোষ্ঠবিহারী দত্ত নামে এক তরুণ অভিনেতা ছিলেন। গোলাপসুন্দরীর সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং উপেন্দ্রনাথের উদ্যোগে তিনি তাঁকে বিয়ে করেন। তারপর থেকে গোলাপসুন্দরীর নাম হয় সুকুমারী দত্ত। ভদ্রলোকের ছেলে বিয়ে করেছেন এক প্রাক্তন রূপজীবিনীকে–এই ঘটনাকে ঘিরে সমাজে গোষ্ঠবিহারীর এতো সমালোচনা হয়েছিলো যে, তিনি সুকুমারীকে ফেলে রেখে কেবল কলকাতা থেকে নয়, দেশ থেকেই পালিয়ে যান। জাহাজের খালাশি হয়ে তিনি চলে যান বিলেতে। ওদিকে, সুকুমারী কেবল এই থিয়েটারে থেকে যাননি, অভিনয়ও চালিয়ে যান। তিনি। বস্তৃত, আর্থিক কারণেই দীর্ঘদিন অভিনয় চালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
স্বামী পালিয়ে যাওয়ার অল্পদিনের মধ্যে (অগস্ট ১৮৭৫) তাঁর নামে ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক প্ৰকাশিত হয় এবং তার পর-পরই তা সফলভাবে অভিনীত হয়। দর্শকরা প্রচুর প্রশংসাও করেছিলেন এ নাটকের। কিন্তু সুকুমার সেনের মতে, এ নাটক সুকুমারীর রচনা নয়। এ বই-এর নামপত্রে রচয়িতা হিশেবে নাম আছে দুটিআশুতোষ দাস এবং সুকুমারী দত্ত। সুকুমার সেনের মতে, আশুতোষ দাস নামটিও ছদ্মনাম, এর আসল লেখক উপেন্দ্ৰনাথ দাস। এ নাটকের ভাষা এতো আড়ষ্ট এবং সংস্কৃতপ্রভাবিত যে, এটি অশিক্ষিতা অথবা সামান্য শিক্ষিতা সুকুমারীর পক্ষে লেখা সম্ভব ছিলো বলে মনে হয় না। তবে এর কাহিনীর সঙ্গে সুকুমারীর নিজের প্রথম জীবনের অনেকটাই মিল ছিলো। সুকুমারীর মতোই এর নায়িকা নলিনী সামান্য লেখাপড়া জানে, তার মা বারবণিতা। সেও সুকুমারীর মতো প্রেমে পড়ে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু বাধার মুখোমুখী হয়। নায়িকা নলিনী আত্মহত্যা করে প্রাণ জুড়ায়, অপর পক্ষে, সুকুমারী স্বামীপরিত্যাক্ত হয়ে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকেন। অভিনয় করতে করতে ১৮৮৩ সালে সুকুমারী শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে হিন্দু ফিমেল থিয়েটার নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং সেখানে ‘শুম্ভ সংহার’ নামে একটি নাটক অভিনয় করান। ১৮৯৮ সালেও তিনি বেঙ্গল এবং মিনার্ভা থিয়েটারে একাধিক নাটকে অভিনয় করেছিলেন। দুর্গেশনন্দিনীতে বিমলা, পুরুবিক্রমে রাণী ঐলবালা, সরোজিনীতে সরোজিনী, সুরেন্দ্র-বিনোদিনীতে বিরাজমোহিনী, মৃণালিনীতে গিরিজায়া, অশ্রুমতীতে মলিনা, বিষবৃক্ষে সূর্যমুখী ইত্যাদি চরিত্রে তাঁর অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেছিলো।