১৮২০ এবং ৩০-এর দশক পর্যন্ত যৌনকর্মীদের প্রতি সমাজের মনোভাব আদৌ কঠোর হয়নি। কিন্তু ১৮৫০-এর দশক নাগাদ তা কঠোর হতে আরম্ভ করেছিলো। সে জন্যেই রাধামণির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও ১৮৫০-এর দশক থেকে যেসব অভিনয় হতে আরম্ভ করে, তাতে নারীদের ডাক পড়েনি। তখন কুলীনকুলসর্বত্ব, বিধবাবিবাহ, শকুন্তলা, বিক্রমোর্বিশী ইত্যাদি নাটকের নারীচরিত্রে অভিনয় করেছেন পুরুষরা। এমন কি, সাহেব মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন ১৮৫৮ সালে নাটক লিখতে শুরু করলেন, তখনো তিনি নারীদের নিয়ে আসতে পারলেন না। আশ্চর্য নয়, বাংলা নাটককে তিনি অলীক কুনাট্য বলে নিন্দা করেছিলেন।
নারীচরিত্রে অভিনয়ের জন্যে মহিলাদের তো পাওয়া যেতোই না, এমন কি এসব চরিত্র অভিনয় করার উপযোগী পুরুষ পাওয়াও সহজ ব্যাপার ছিলো না। সে জন্যে নাট্যকারীদের এমনভাবে নাটক লিখতে হতো, যাতে নারীচরিত্র কম থাকে। কৃষ্ণকুমারী লেখার সময়ে মাইকেল নানা রকম যোগবিয়ােগ করে শেষ পর্যন্ত চারটি নারীচরিত্র রেখেছিলেন। কারণ তিনি চারজন অভিনেতাকে চিনতেন, যারা এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি অভিনেত্রী জোগাড় করতে সক্ষম হননি, অথবা বাংলা রঙ্গমঞ্চে নারীচরিত্রে মহিলাদের অভিনয় করতেও দেখেননি। তা সত্ত্বেও মৃত্যুর ঠিক আগে সামান্য টাকার জন্যে তিনি যখন বেঙ্গল থিয়েটারের ফরমায়শে মায়াকানন নাটকের ডিকটেশান দেন, তখনো শরৎচন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন যে, অভিনেত্রী ছাড়া নাটকের সফল অভিনয় হতে পারে না, অথবা অভিনয়ের উন্নতিও নয়। অনেকটা তার উৎসাহে শরৎচন্দ্ৰ অভিনেত্রী নিয়ে এসেছিলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু তার মাস দেড়েক আগেই— ১৮৭৩ সালের ২৯শে জুন–মাইকেল শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
আসলে, বাঙালি সমাজে নারীদের প্রতি একটি দ্বৈত মনোভাব আগাগোড়াই লক্ষ্য করা যায়। নারীদের দু ভাগে ভাগ করে দেখেছে। এ সমাজ।। ঘরের নারী আর বাইরের নারী। পুরুষরা আশা করতেন ঘরের নারীরা হবেন পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গীর মতো। সতীসাধ্বী হবেন। বন্দী থাকবেন অন্তঃপুরে। সন্তান জন্ম দেবেন, তাদের লালনপালন করবেন। ঘরের কাজ করবেন। আর, রাতের বেলা স্বামী বাড়িতে থাকলে মুখ বুজে তাঁকে শারীরিক সুখ দেবেন। শীৎকার কথাটা প্রযোজ্য ছিলো বেশ্যাদের জন্যে, ভদ্রমহিলাদের জন্যে নয়। তাঁরা লাজনম হবেন। যৌনসুখও নীরবে উপভোগ করবেন। তাঁরা প্রিয়া নন, তারা সন্তানের জননী।
ফুর্তি করার জন্যে পুরুষরা যেতেন বাইরের নারীদের কাছে। তাঁরা আশা করতেন এই নারীরা হবেন নাচ-গান জানা, খানিকটা লেখাপড়া জানা, চালাক-চতুর, বেশভূষায় স্মার্ট, যৌনকর্মে নানা কৌশলের অধিকারী। সবচেয়ে বড়ো কথা, এঁরা হবেন অসতী। এই নারীদের মধ্যে অনেকেই প্ৰচিলত অর্থে যৌনকামী ছিলেন না। তারা ছিলেন রক্ষিতা। বাবুরা রক্ষিতা রাখতেন। রক্ষিতা রেখে গর্ব করতেন। প্ৰেমভালোবাসাও করতেন এই রক্ষিতাদের সঙ্গে। রামমোহন রায়ের জীবদ্দশায় সবচেয়ে নাম-করা বাইজী ছিলেন নিকি। সাহেব-মেম সাহেবরাও তার সৌন্দর্য এবং গুণের ংসা করেছেন। এক লাখ টাকা দিয়ে এক বাবু তাঁকে রক্ষিতা রেখেছিলেন। ভাৰ্যার সঙ্গে প্রেম হতো না, ভাৰ্যা ছিলেন কেবল পুত্র জন্ম দেওয়ার জন্যে। যৌনতার ব্যাপারে এক আশ্চর্য রকমের দ্বৈতমান এবং ভণ্ডামি ছিলো পুরুষ সমাজের। তাঁরা স্ত্রী ছাড়া অন্য মেয়েদের উপভোগ করলে, অসৎ বলে তাদের অখ্যাতি হতো না, কিন্তু মেয়েরা অন্যের ছায়া মাড়ালেও অসতী বলে কুখ্যাত হতেন। অভিনয়ের জন্যে যখন নারীদের প্রয়োজন হলো তখন তাই ঘরের মেয়েরা নন, বাইরের মেয়েদের, “খারাপ মেয়েমানুষ”দের ডাক পড়লো।
বেঙ্গল থিয়েটার মহিলাদের মঞ্চে নিয়ে এসে বাংলা নাটক বিকাশ লাভের পথ প্রশস্ত করেছিলো। কিন্তু তখন মহিলাদের অভিনয়ে মস্ত দুটি বাধা ছিলো। একদিকে, অভিনয় করতে জানতেন, এমন মহিলা ছিলেন না–তারা তো সাত জন্মে অভিনয় করেননি! অন্য দিকে, দর্শকরা মঞ্চে মহিলাদের দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন না। অনেকে দেখতে চাইতেনও না। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর এবং শিবনাথ শাস্ত্রী কেবল সমাজসংস্কারক ছিলেন না। তারা ছিলেন নারীদরদী এবং মহিলাদের উন্নতি চাইতেন আন্তরিকভাবে। দুজনই অভিনয় দেখতেও ভালোবাসতেন। কিন্তু বেঙ্গল থিয়েটার অভিনেত্রীদের নিয়ে আসার পর এরা আর কোনোদিন সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় দেখতে যাননি। সে যুগের বিখ্যাত ব্ৰাহ্ম নেতা কেশব সেনও ছিলেন এঁদের মতো। তিনিও মহিলাদের উন্নতি চাইতেন। মেয়েদের ব্যাপারে বেশ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিও ছিলো তাঁর। এমন কি, নিজে নাটকের অভিনয়ও করেছেন। কিন্তু ১৮৭৯ সালে তিনি সাধারণ রঙ্গমঞ্চে মহিলাদের নিয়ে অভিনয় করার বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর সুলভ সমাচার পত্রিকায়। এঁদের মতো অন্য অনেক দর্শকেরও মহিলাদের অভিনয়ের ব্যাপারে বিরূপ মনোভাব ছিলো।
নারীদের দিয়ে স্ত্রীভূমিকায় অভিনয় করানোর উদ্যোগ নিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার রীতিমতো অভিনয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিলো। গোড়াতে যে-চারজন অভিনেত্রী এসেছিলেন, তারা ছিলেন জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী এবং শ্যামা। এঁদের অভিনয়ের কোনোই অভিজ্ঞতা ছিলো না। সবাই লেখাপড়াও জানতেন না। কিন্তু সবাই কমবেশি নাচ-গান জানতেন। জীবিকার প্রয়োজনেই এঁরা ছেলেবেলা (অথবা মেয়েবেলা) থেকে নাচ-গান শিখতেন, কারণ এঁরা ছিলেন রূপজীবিনী। একে মহিলাদের মঞ্চে নিয়ে আসা, তদুপরি সেই মহিলারা আবার রূপজীবিনী–এই দুই কারণে পুরুষ-পরিচালিত অনেক পত্রপত্রিকাই বেঙ্গল থিয়েটারের তীব্র সমালোচনা করেছিলো। কিন্তু সমালোচনা সত্ত্বেও বেঙ্গল থিয়েটার যে তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিলো তার অন্যতম কারণ হয়তো অভিনেত্রীদের নিয়োগ।