তসলিমা অবশ্যই বলতে পারেন যে, তার বাকস্বাধীনতা আছে। তিনি যা খুশি লিখতে পারেন, এবং অন্যরা যা খুশি লিখে তাঁর উত্তর দিতে পারেন। কিন্তু সত্যি কি তাই? বাক প্রকাশের স্বাধীনতা কি অফুরন্ত, সীমাহীন? আমি রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে যা খুশি তাই বলতে পারি? বাক প্রকাশের সঙ্গে কি ঔচিত্যবোধ৷ এবং মানবকল্যাণের ধারণার কোনো যোগাযোগ নেই? বছর পনেরো আগে, সালমন রুশদী তার শয়তানের পদাবলী লিখেছিলেন। তার মধ্যে সরাসরি ইসলাম ধর্মের প্রবর্তকের চরিত্র নিয়ে অশ্ৰীল কোনো কথা ছিলো না। তা ছাড়া, তিনি লিখেওছিলেন, সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ রীতিতে, রেখে-ঢেকে। কিন্তু তাই নিয়ে দাঙা বঁধলো দেশে দেশে। নিরপরাধ কতোগুলো মানুষের জীবন গেলো। এই উগ্ৰবাদী দাঙার নিন্দা আমরা অবশ্যই করতেই পারি। আবার এ দাঙার ব্যাপারে সালমান রুশদীর দায়িত্বও ভুলে যেতে পারিনে।
বাক প্রকাশের স্বাধীনতা অবশ্যই আছে। সভ্যতার, মানবতার এটা একটা আবশ্যিক শর্ত। কিন্তু বাক প্রকাশের স্বাধীনতা কি অ্যাবসোলুট? চরম? অন্য কোনো বিবেচনা যার কাছে ঠাই পাবে না? তা হলে যে-বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে মারণাস্ত্ৰ আবিষ্কার করেন, তাঁদের কেন নিন্দা করবো? পর্নোগ্রাফি তৈরি করে যাঁরা অনেকের অনুভূতিকে উস্কে দেন, তাদের কেন নিন্দা করবো? আমার মনে হয়, বাক স্বাধীনতার সঙ্গে মানবকল্যাণের ধারণাটাও জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বের যোগাযোগও অস্বীকার করা যায় না।
সব শেষে একটা কথা মনে হচ্ছে। তসলিমা কলম হাতেই আমাদের সামনে হাজির হয়েছিলেন। এবং রাতারাতি লাভ করেছিলেন অসামান্য খ্যাতি। তার কবিতা এবং ধারালো গদ্যই নয়, তাঁর খ্যাতির একটা প্ৰধান কারণ নারীমুক্তির সংগ্রামে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা। সেই ভূমিকায় তাঁকে অটল থাকতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তিনি নারীমুক্তির পথ থেকে সরে গিয়ে অবশ্যই লেখিকার ভূমিকা নিতে পারেন। অথবা সেটাকেই বড়ো করে তুলতে পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে: তাঁর সত্যিকার শক্তি কোথায়? আমার মনে হয়, সীমাহীন সাহসে আর আত্যন্তিক আন্তরিকতায়। অনেক কাল আগে রবীন্দ্রনাথ একটি তরুণের মধ্যে একই ধরনের অসামান্য শক্তি লক্ষ্য করে তাকে বলেছিলেন, তুমি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাচিছো। আশা করি, প্রতিভাবান এবং প্ৰতিশ্রুতিশীল তসলিমা তার শক্তির অপচয় করবেন না।
(প্ৰথম আলো, মার্চ ২০০৫)
০৫. সুকুমারী থেকে সুচিত্রা
১৮১৯ সালে রামমোহন লিখেছিলেন যে, মহিলাদের মেধা বা বুদ্ধি আছে, পুরুষরা তার কোনো পরীক্ষা নেননি। তা সত্ত্বেও তাদের তারা নির্বোধ বলে সাব্যস্ত করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার এই প্রবণতা অবাঞ্ছিত হলেও অপ্রত্যাশিত ছিলো না–বিশেষ করে যে-সমাজে নিন্দার্থে “স্ত্রীবুদ্ধি” বলে একটা কথা চালু ছিলো। সে জন্যে মেয়েরা অভিনয় করতে পারেন, এ ধারণাই কারো মাথায় আসেনি। চৈতন্যদেব মেয়েদের কিছু অধিকার এবং সম্মান দিয়েছিলেন। তাঁর অনেক মহিলা শিষ্যও ছিলেন। কিন্তু তবু ‘নাটক’ অভিনয়ের সময়ে তিনি নিজে স্ত্রীচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, মেয়েদের অভিনয় করতে ডাকেননি। তার প্রায় তিন শতাব্দী পরে গেরেশিম লেবেদেফ যখন ১৭৯৫ সালে বাংলায় কাল্পনিক সংবদল” নামে একটি নাটক লিখে তার অভিনয় করানোর উদ্যোগ নেন, তখন তাঁর বাংলার শিক্ষক গোলোকনাথ দাস এই অভিনয়ের জন্যে তাকে কেবল অভিনেতা নয়, একাধিক অভিনেত্রীও জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এই নাটক প্রথম বার অভিনীত হয় ১৭৯৫ সালের ২৭শে নভেম্বর তারিখে আর দ্বিতীয় বার পরের বছর ২১শে মার্চ তারিখে। দুবারই তাঁর থিয়েটার দর্শকে ভরে গিয়েছিলো। এ থেকে বোঝা যায় যে, এই নাটকের অভিনয় বেশ সফল হয়েছিলো। মহিলারাও হয়তো ভালো অভিনয় করেছিলেন। এতে যে-মহিলারা অংশ নিয়েছিলেন, তারা ছিলেন বাইজি অথবা ঐ শ্রেণীর মহিলা। তথাকথিত ভদ্রমহিলা নন।
আঠারো শতকের শেষ দিকে কলকাতায় থিয়েটার অপরিচিত ছিলো না, কারণ ততোদিনে সেখানে একাধিক ইংরেজি থিয়েটার চালু হয়েছিলো। সেই পরিবেশে লেবেদেফ যে-উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা ছিলো ভোর রাতে যে-পাখি ডাকে, তার মতো। তারপর বহু বছর কোনো স্বদেশী অথবা বিদেশী বাংলা ভাষায় নাটক অভিনয় করানোর কোনো উদ্যোগ না-নিলেও বাঙালি সমাজ চিরকাল ঘুমিয়ে থাকতে পারেনি। প্রসন্নকুমার ঠাকুর অভিনয় করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৮৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু তখন নারীচরিত্রে কোনো মহিলা অভিনয় করেছিলেন বলে জানা যায় না। অপর পক্ষে, ১৮৩৫ সালের অক্টোবর মাসে নবীনচন্দ্ৰ বসু নামে একজন ধনীর উদ্যোগে শ্যামবাজারে বিদ্যাসুন্দরের যে-অভিনয় হয়েছিলো, তাতে একাধিক মহিলা অভিনয় করেছিলেন। এঁদের মধ্যে দুজনের নামও জানা গেছে–রাধামণি আর জয়দুর্গা। রাধামণি অভিনয় করেছিলেন বিদ্যার ভূমিকায়। ষোলো-সতেরো বছর বয়সী এই মেয়েটি অভিনয় এবং গানে এতো পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন যে, সমসাময়িক পত্রিকায় তাঁর খুব প্রশংসা করা হয়েছিলো। তাঁর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে একটি পত্রিকায় এও লেখা হয়েছিলো যে, তাঁর অভিনয় থেকে প্রমাণিত হয় যে, মহিলারা যথেষ্ট মেধার অধিকারী।