খিদের পরেই যৌনতা আমাদের একেবারে জীবনের সবচেয়ে বড়ো অনুভূতি। কাজেই যৌনতার কথাও না-হয় ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এমন সব অপ্রয়োজনীয় স্কুল বিষয় নিয়ে এসেছেন। তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীতে, যা আমাদের বিস্মিত না-করে পারে না। তাঁর দুই বড়ো ভাই কে কতো জোরে দুৰ্গন্ধওয়ালা বায়ু ছাড়তে পারেন, তার প্রতিযোগিতা করেন। এই তুচ্ছ ঘটনা কি লেখার মতো একটা বিষয়? কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এর থেকেও তুচ্ছ এবং বমি-উদ্রেককারী ঘটনার কথাও তিনি লেখেন তাদের সম্পর্কে। নিজেই স্বীকার করেন, তা দেখলে পেটে যা কিছু আছে, তা বেরিয়ে আসে:
“লুঙ্গি পরেই তিনি যখন চুলকোনো শুরু করেন পা ফাঁক করে দু উরুর মধ্যিখানে, তখন দেখে মনে হয় না দাদা আদৌ কোনও সুর্দশন পুরুষ। এর পরও যে-কাণ্ড করেন, সেটি দেখলে কেবল বমির উদ্রেক নয়, রীতিমতো পেটে যা কিছু আছে সত্যিকার বেরিয়ে আসে। গায়ের ময়লা অর্থাৎ দুই উরুর মাঝখানের, হাতে ডলে তুলে কালো গুলি বানিয়ে ফেলে দেওয়ার আগে তিনি শুঁকে দেখেন। দাঁতের ফাঁকে বাধা মাংস এনেও গুলি বানিয়ে শোঁকেন।“
আমার প্রশ্ন হচ্ছে: তাঁর নিজেরই যদি মনে হয় যে, এটা বমি উদ্রেককারী, তা হলে সেটা আর পাঠকদের উপহার দেন কেন? কার লাভ তাতে? পাঠকের? তাঁর?
তসলিমা কেবল নারীবাদী নন, তিনি সম্ভবত নারীশ্রেষ্ঠতাবাদী এবং নরবিদ্বেষী। পুরুষদের তিনি আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন। নিজের পরিবারের পুরুষ-সহ পরপুরুষেরা তাঁর ওপর এতো ধরনের অত্যাচার করেছেন যে, তাদের ঘৃণা করলে তাঁকে আমি দায়ী করতে পারিনে। তিনি যখন ডাক্তারি করছেন, সেই সময়ে তাঁর পিতা যেভাবে তাকে মারধর করেন, তাকে বাড়িতে তালা দিয়ে বন্দী করে রাখেন, ঘরের মধ্যে একটা বালতি দেন পায়খানা-প্রস্রাব করার জন্যে, তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকে হারিয়ে দিতে পারে। তাঁর এক স্বামী তাঁকে যেভাবে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে পুরুষত্ব দেখান, তাতে সে রকম পুরুষদের ঝাটা মারলে তসলিমাকে দোষ দেওয়া যায় না। বারবার যেভাবে পুরুষরা তাঁকে প্রতারনা করেন, তাতে পুরুষবিদ্বেষী হতেই পারেন তিনি।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও স্বীকার করবো, তসলিমার চরিত্র বোঝার ক্ষ্যামতা আমার নেই। সেই বেল্টওয়ালা স্বামীর ভয়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন তসলিমা। বিয়ে ভেঙে যায়। তারপর সেই পুরুষ যখন আবার তাঁর দেহ চান, তসলিমা তাতে তক্ষুণি রাজি হন। এ কি একজন আপোশহীন সংগ্রামী নারীবাদীর চরিত্ৰ? অথচ তিনি মোল্লাদের বিরুদ্ধে যে-অবস্থান নিয়েছিলেন, তাতে তাঁকে দুর্বল চরিত্রের মানুষ বলবো কিভাবে?
পুরুষরা নারীদের এক্সপ্লয়েট করেছে যুগে যুগে। তার জন্যে আজ কি মেয়েরা এক্সপ্লয়েট করবে পুরুষদের? সব পক্ষের এক্সপ্লয়টেশান বন্ধ করাই তো একজন মানবতাবাদীর কর্তব্য, তাই না? কিন্তু তসলিমা তাঁর কবিতার অনবদ্য ভাষায় লেখেন:
আমার খুব ছেলে কিনতে ইচ্ছে হয়
ডাঁশা ডাঁশা ছেলে, বুকে ঘন লোম–
ছেলে কিনে ছেলেকে আমূল তছনছ করে
কুঞ্চিত অণ্ডকোষে জোর লাথি কষে বলে উঠব–যাহ্ শালা।
এতো পুরুষের উল্টো পিঠ! পুরুষের সঙ্গে এখানে তাঁর চরিত্রের কোনো ফারাক নেই। আমি তা হলে তাকে আদর্শবাদী বলবো কেন? মহৎ বলবো কেন? নারীবাদ কি মানবতার চেয়েও বড়ো?
দ্বিখণ্ডিত ওরফে ক পড়ে আরও একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো। তসলিমার অনেক পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। হতেই পারে। পারস্পরিক সম্মতিতে প্রাপ্তবয়স্ক লোকেদের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে–সেটা তাঁরাই বিবেচনা করবেন। কিন্তু সেই সম্পর্ক অতীত হলে, সে সম্পর্কে লেখা সঙ্গত কিনা এবং লিখলে, সেটাকে কেউ এক্সপ্লয়টেশান বলতে পারেন। কিনা। একজনকে ব্যবহার করে অথবা একজনের কাছে ব্যবহৃত হয়ে, তারপর সেই অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনী বর্ণনা করে বই লিখে পরিচিতি অর্জন করা, টাকা উপার্জন করা—এটাকে কি ফেয়ার প্লে বলা যায়?
তা সত্ত্বেও স্বীকার করবো, প্রথমে ব্যবহার করে তারপর প্রতাড়না করে থাকলে, আক্রোশের আগুনে জুলে তার বিরুদ্ধে মন্তব্য করা অসম্ভব নয়। মানুষ তো! কিন্তু কারো সম্পর্কে কেবল শুনে তার চরিত্র হননের অধিকার আমাদের আছে কি? প্রসঙ্গত আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে আদর্শ খুব কম। আদর্শ চরিত্র, রোল-মডেল, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বও কম। যে-স্বল্পসংখ্যক চরিত্র আছেন, সমাজ যাদের কথা শোনে, যারা আমাদের বিবেকের কথা বলেন সংকটকালে, সেই মুষ্টিমেয় চরিত্রগুলো ধ্বসিয়ে দিয়ে লাভ কি? বিশেষ করে শোনা-কথার ওপর নির্ভর করে?
ব্যক্তিগত জীবনে তসলিমা মৃদুভাষী, অত্যন্ত বিনয়ী। অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। কিন্তু বল্লমের মতো কলম হাতে যে-তসলিমাকে দেখি, তিনি খুব বিনয়ী নন। তাঁর ভাষা, তাঁর বর্ণনা কখনো কখনো শোভন সীমানা ছাড়িয়ে যায়। আমরা যখন একজন মাননীয় ব্যক্তি সম্পর্কে বলি, বয়স্ক লোক সম্পর্কে বলি, এমন কি, গল্পের শ্রদ্ধাভাজন কোনো চরিত্র সম্পর্কে বলি, তখন সাধারণত আমরা ক্রিয়াপদের শেষে “ন” লাগিয়ে সম্মান দেখাই। রামায়ণের রামচন্দ্র রক্তমাংসের মানুষ সম্ভবত নন। খুব সম্ভব কল্পিত চরিত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর সম্পর্কে যখন লিখি, তখন মনে হয়, তাঁকে সম্মান দেখানোই সাধারণ সৌজন্য। না-দেখালে, নিজেকেই ছোটো করা হয় আসলে। রক্তমাংসের চরিত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র–বিশ্বের একটা বড়ো ধর্মের প্রবর্তক সম্পর্কে লিখতে গিয়েও তসলিমা তার প্রতি সম্মান দেখাননি। আমি কি বলতে পারি, “ব্যাটা” ধর্মপ্রবর্তক? আমার মনে হয়, তাকে মানি অথবা না-ই মানি, এটা লেখা শোভন নয়। এমন কি, এটা লিখে আমি এমন বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারি, যা থেকে আমার অমঙ্গল হতে পারে, একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে হানাহানি হতে পারে।