বাংলা ভাষায় প্রথম আত্মজীবনী ছাপিয়েছিলেন একজন ভদ্রমহিলা–রাসসুন্দরী দেবী (১৮৬৯)। তারপর থেকে শত শত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। জীবনস্মৃতি এবং ছেলেবেলার মতো আত্মজীবনী সবাই লিখবে–এটা প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু আত্মজীবনী কি কেবল সমাজ এবং সংসারের অত্যাচার, কেবল যৌনকর্ম, কেবল কুৎসার কেচ্ছা?
তসলিমা একালের একজন বিখ্যাত বাঙালি। যদি পরিচিতির পরিধি বিবেচনা করি, তা হলে দেশে-বিদেশে তাঁর চেয়ে বিখ্যাত বাঙালি গত পঁচিশ বছরে অন্য কাউকে দেখতে পাইনে। তাঁর পরিচিতি এবং বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি দেখে গর্বিত হই। কিন্তু তাঁকে যখন নিচে নামতে দেখি, তখন অবিমিশ্রভাবে দুঃখ অনুভব করি। কয়েক মাস আগে তাঁর আত্মজীবনীর তৃতীয় সর্গ প্রকাশিত হওয়ার পর বিবিসি থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, চরিত্র হনন করে তিনি অন্যদের ছোটো করলেন কেন? তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি যদি কাউকে ছোটো করে থাকেন, তা হলে নিজেকেই ছোটো করেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছিলেন কিনা, জানিনে। কিন্তু এ কথাটা যে ষোলো আনা সত্যি, সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। আমি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করি, যে-তসলিমা অমন মহৎ উদেশ্য নিয়ে সাহিত্যের আসরে নেমেছিলেন, শুরুতেই অমন শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে আত্মজীবনী অবশ্যই চাই, কিন্তু তার মধ্যে তিনি যেসব ময়লা মিশিয়ে দিচ্ছেন, সেসব নয়। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে বলতে হবে, তা না হলে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না।
মেয়েবেলা নামটাই চকিতে তসলিমার নারীবাদী মনোভাবকে মনে করিয়ে দেয়। আমাদের ভাষা যে সেকসিস্ট, সেটাকে তিনি সুন্দরভাবে শুধরে দিয়েছেন। তাকে সাধুবাদ জানাই। এ বইতে তিনি তাঁর ওপর নিকট-আত্মীয়দের যেসব অত্যাচার এবং বৈষম্যের কথা লিখেছেন, তাতে তাঁর অকপট ভাষণ এবং সৎ সাহসেরও তারিফ না-করে পারিনে। তসলিমা ডাক্তার। তিনি জানেন, অনেক ওষুধই আসলে বিষাক্ত। সেসব ওষুধ ঠিক মাত্রায় খাওয়ালে রোগী সেরে ওঠে, কিন্তু মাত্রা বেশি হলে রোগী মরেও যায়। মাত্রা ঠিক রাখা যে-কোনো বড়ো লেখকের কাজ। কে কতো বড়ো, তার একটা পরিমাপও। বালিকা তসলিমাকে ধর্ষণ করতে চান তাঁর দুই নিকটাত্মীয়। এমন ঘটনা কি বাঙালি সমাজে এই প্ৰথম ঘটলো? মোটেই না। কিন্তু তসলিমা এই প্রথম লিখলেন। তাঁর অসাধারণ সাহস এবং স্পষ্টভাষণের প্রশংসা না-করে পারছিনে। কিন্তু ধর্ষণ করতে চেষ্টা করার সময় তারা কাপড় খুলেছিলেন। কিনা, কতোটা খুলেছিলেন, অথবা আর কি কি করেছিলেন, তা বলার কি দরকার আছে? তার থেকেও বড়ো কথা, সে কথা বলে কি লাভ হচ্ছেনিজের বা পাঠকের?
ওপর রুদ্র এবং তসলিমা উভয়ই কবি। সুতরাং তসলিমা সে মিলনের দীর্ঘ এবং উচ্ছসিত বর্ণনা দিতেই পারেন। কিন্তু তিনি যে-বৰ্ণনা দেন, তা কবির নয়।
“রুদ্র আমাকে চুমু খায়। ঠোঁটে গাঢ় করে চুমু খায়। … শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে ফেলে। ব্লাউজের বোতাম খুলে মুখ ডুবিয়ে দেয়। স্তনবৃন্ত কেবল ভিজিয়ে দেয় না, দাঁতে কাটে। দুহাতে মুঠো করে ধরে স্তন, মুঠোর ভেতর এমন জোরে চাপে, যেন গলিয়ে একে জল বানাবে… রুদ্র আমার শাড়ি ওঠাতে থাকে ওপরের দিকে…আমার শরীরের ওপর নিজের শরীর তুলে দিয় রুদ্র। …এর পর সেই একই পদ্ধতি, দু পায়ে বিযুক্ত করতে থাকে আমার দু পা।… এর পর আচমকা একটি আঘাতে আমি চিৎকার করে উঠি। … রুদ্র ক্রমাগত আঘাত করেও নড়াতে পারে না কোনও পাথর। শরীর থেকে নেমে এসে রুদ্র তার আঙুল ব্যবহার করে অদৃশ্য পাথর সরাতে। … যে করেই হোক পথ প্রশস্ত করে তার এগোতে হবে, …”
এ বর্ণনা ধর্ষণের মামলায় পুলিশ অথবা কোর্টের সামনে বাধ্য হয়ে দিতে হতে পারে। কিন্তু কেউ আত্মজীবনীতে লিখতে পারেন— এটা বিশ্বাস করা শক্ত। অভিনব অবশ্যই। এমন কি, তিনি যদি এর মাধ্যমে রুদ্র অথবা পুরুষের ধৈর্য এবং বিবেচনার অভাব বোঝাতে চেয়ে থাকেন, তা হলেও।
রুদ্রকে ভালোবাসার সাধ মেটেনি। তসলিমার। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। রুদ্রই। অন্য মেয়ের অথবা বেশ্যার] সংসৰ্গ করেছেন। রুদ্র। তারই ফল সিফিলিস উপহার দিয়েছেন তসলিমাকে। কিন্তু এতো সব সত্ত্বেও ভালোবাসার সাধ মেটেনি বলেই রুদ্রকে আঘাত করলেও, বারবার তাঁর জন্যে তসলিমা এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করেছেন। একটা ঘটনার কথা বলি। রুদ্রের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে গেছে। অন্যের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। সে বিয়েও ভেঙে গেছে। তারপর একদিন রুদ্রের সঙ্গে দেখা। মলিন মুখ, অসুস্থ দেহ। তসলিমা তাঁকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। যত্ন আত্মি করলেন। রাতের বেলায় শুতে দিলেন নিজের কাছেই। বাকিটা আমরা আহাম্মুক হলেও মোটামুটি অনুমান করে নিতে পারি। আত্মজীবনী কেন, উপন্যাসের জন্যেও এটাই যথেষ্ট। এ দিয়ে তিনি কিছু মাত্র অর্জন করতে পারেন না। পারেননি। কিন্তু তসলিমা সেখানে থামেননি তা সত্ত্বেও। এবং সে কারণেই এটা পর্নোগ্রাফির চেয়েও বেশি পর্নোগ্র্যাফিক। কারণ, এটা উপন্যাস নয়, আত্মজীবনী। সে কারণেই তাঁর পুরুষ-ঘূণা সত্ত্বেও তাঁর এসব লেখার বেশির ভাগ পাঠক পুরুষ।
সত্যি বলতে কি, তাঁর ইদানীংকার লেখাগুলো পাঠকদের যৌন-অনুভূতিকেও সুড়সুড়ি দিতে পারে। যে-পুরুষের মুখে তসলিমা আগুন দিয়েছেন, সেই পুরুষরাই এই রচনা গোগ্রাসে গিলবেন। আমি বুঝতে ব্যর্থ হই, তসলিমা এসব লিখছেন কেন? তা হলে বই বেশি বিক্রি হোক, তাঁর লেখা (যে উপায়েই হোক না কেন) বেশি প্রচারিত হোক, এটাই কি তাঁর উদ্দেশ্য?