এক-একটা কবিতায় নারীদের এক-একটা বেদনা, এক-একটা ক্ষোভের কথা বলেছেন তসলিমা। অসহ্য বেদনার কথা–পুরুষের প্রবঞ্চনা, সীমাহীন শোষণ, বমিউদ্রেককারী ভণ্ডামি, নিরঙ্কুশ স্বার্থপরতা, নির্লজ্জ বৈষম্য, নিষ্কারুণ হৃদয়হীনতা, নারীকে ভোগ্যবস্তু হিশেবে ব্যবহার করে ছিবড়ের মতো ফেলে দেওয়া ইত্যাদি। আমি আমার দুর্বল (এবং জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে পুরুষালি) ভাষা দিয়ে তাঁর অভিযোগের তীব্ৰতা ঠিক বোঝাতে পারবো না, তাই তার ভাষাতেই বলি:
১. আমার শরীর চেয়েছে সে নিজের অধীন। / ইচ্ছে করলেই যেন মুখে থুতু, গালে চড়, নিতম্বে চিমটি দিতে পারে।
২. প্রতি রাতে আমার বিছানায় এসে শোয় এক নপুংসক পুরুষ। …আমাকে উত্তপ্ত করে নপুংসক বেঘোরে ঘুমোয়।
৩. আপাতমস্তক তুমি এক ভণ্ড, প্রতারক / তোমার লাম্পট্য সব জানি
৪. কিছুটা কায়দা করে রমণীকে ভোগ না হলে / সে ভোগে তৃপ্তি নেই, তৃপ্তির সুগন্ধী ঢেকুর নেই।
৫. পুরুষেরা ভদ্রলোক, / পুরুষের জন্যে সতীত্বের সনদ লাগে না।
৬. একশ’ একর জমি নিজস্ব রেখে / এক কাঠা খোজ বর্গার তাড়নায় / বর্গার চাষ পৃথক স্বাদের কিনা!
৭. বেহেস্তের লোভে নারীরা চেটে খাবে / স্বামীর ধুলো কাদা / নিয়ম নীতি সব তৈরি করেছিল / পুরুষ নামজাদা। (এখানটায় ছন্দপতন৷ হলো–পুরুষ তিন মাত্রা, তারপর নামজাদা চার মাত্রা। যদি লিখতেন, পুরুষ হারামজাদা, তা হলে মনের কথা বলা হতো। কিনা জানিনে, ছন্দ রক্ষা পেতো।)
৮. ছুয়েছে সে সব, কেবল দেখেনি ছুয়ে / … যে হৃদয় সেধেছিলাম।
৯. যে কারণে নারী বেশ্যা হয়, যে সংসর্গে, … একই সংসর্গে পুরুষ পুরুষই থাকে।
১০. ভালোবাসা ছাড়া কোনো মাংসের শরীর ছুতে / পারঙ্গম জন্তু ও পুরুষ / নারী নয়।
পুরুষের এসব এবং অন্য আরও নানা ধরনের অত্যাচারের মর্মান্তিক সত্য কথা তুলে ধরেছেন তসলিমা। সেই সঙ্গে তুলে ধরেছেন নারীদের নীরবে-নিভৃতে-কাঁদা বঞ্চনার কথা। তাঁর বিরুদ্ধে পুরুষ সমাজে হৈচৈ হবে না কেন! হওয়াওই তো স্বাভাবিক।
তবে স্বীকার করতে হবে, পুরুষরা তাঁর ওপরই প্রথম অত্যাচার করেনি, সনাতন কাল থেকে তাবৎ নারীর ওপরই অত্যাচার করেছে। তা হলে, তিনি কলমের বল্লম তুলে নিলেন কেন? আমি অনেক বছর আগে একবার বিবিসির হয়ে তাঁকে এ কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। নানাভাবে প্রশ্ন করেও উত্তরটা তখন ঠিক পাইনি। তবে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সেইদিন হবেন ক্ষান্ত, যাবে পুরুষের লাথিচড় গৃহরণভূমে রণিবে না। তিনি মহিলাদের সচেতনতা জাগাবেনই জাগাবেন। সচেতন করে তুলবেন পুরুষেরও— তাদের আচরণ সম্পর্কে। এবং আমার সত্যি বিশ্বাস, তাঁর সৎ সাহস এবং সংগ্রামী স্পিরিট দেখে ৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বহু বঙ্গনারী উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন, সাহস পেয়েছিলেন। নীরবতা ভেঙে কথা বলতে শুরু করেছিলেন। এটা কম অর্জন নয়। এ জন্যে তাঁর কাছে, আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অন্তত, আমি কৃতজ্ঞ।
কিন্তু তারপর কী হলো?
বলতে গেলে অনেক বলতে হবে। তার চেয়ে এখনটায় দশ-বারো বছরের ইতিহাস পাখির চক্ষু দিয়ে দেখছি।
তসলিমা সংস্কারকের ভূমিকা নিয়ে খুশি থাকতে পারলেন না। রাতারাতি বিপ্লব চাইলেন তিনি। কিন্তু অন্ত্রশস্ত্ৰ, দলবল না-জুটিয়ে বিপ্লব করা তো সম্ভব নয়। করলে সেটা ক্ষুদিরাম কি বাঘা যতীনের মতো আত্মহত্যার সামিল হয়। এমন কি, বিপ্লবের কারণটাও পিছিয়ে যায়। কারণ, গৃহস্থ হুশিয়ার হয়ে যায়। পটভূমি তৈরি হবার আগেই অকাল বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে তসলিমা নিজে ডুবলেন, নারীদেরও বোধ হয় পিছিয়ে দিলেন। তাঁর কট্টরপন্থী মনোভাব এবং ধর্মের ওপর প্রচণ্ড আঘাত ঐতিহ্যিক সমাজ নিতে পারলো না।
দেশের আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফতোয়া দিলেও ফতোয়াবাজরা তাঁকে মারতে পারলেন না। কিন্তু তাঁকে বিচলিত করলেন তাঁর আসল পথ থেকে। কখন যে তিনি তাঁর পথ এবং লক্ষ্য থেকে সরে গেলেন, বোধহয় তিনি নিজেও তা টের পেলেন না। ধর্মীয় রাজনীতির শিকার হয়ে তসলিমা দেশ ছাড়লেন। যাদের জন্যে কাজ করতে শুরু করেছিলেন, তাদের থেকে দূরে ছিটকে পড়লেন। যাদের জন্যে লিখছিলেন, সেই লেখা নিষিদ্ধ হয়ে তাদের কাছে আর পৌছলো না। এমন কি, তার হঠকারিতায় বাংলাদেশের সাধারণ নারীদের উন্নতির মন্থর গতিও বোধ হয় আরও মন্থর হয়ে গেলো। আর, বনবাসে গিয়ে তিনি স্বয়ং তাঁর লক্ষ্য হারিয়ে ফেললেন। তিনি নারীদের সবার কথা না-লিখে, নিজের কথা লিখতে শুরু করলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার জেহাদ বন্ধ করে, বরং এমন সব কথা বলতে আরম্ভ করলেন ধর্ম এবং নৈতিকতা থেকে যা অনেক দূরের।
তিনি যেসব কথা বললে শুরু করলেন, তার উৎস ছিলো। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর নিজেরই পরিবারে। ‘৯৩ সালে অতোভাবে প্রশ্ন করেও যেসব কথা তার কাছ থেকে বের করতে পারিনি, সেই কথা তসলিমা নিজেই অকাতরে বলতে শুরু করলেন মহাকাব্যের মতো সর্গে সর্গে। আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখলেন তিনি। কিন্তু তার থেকেও সিয়েরিয়াস–প্ৰচণ্ড চিৎকার করে একেবারে নিজের জীবনের কথা লিখলেন। তার প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো উপন্যাস হিশেবে যেমনই হোক, অন্তত তার মধ্যে এক ধরনের শিল্প সৃষ্টি করার প্রয়াস ছিলো। ইংরেজিতে যাকে বলে কাজ, তেমন একটা কজও ছিলো। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিলো, নিপীড়িত মানবতার কথা ছিলো। নারীদের ওপর অত্যাচারের কথাতো ছিলোই। কিন্তু নির্বাসনে গিয়ে তিনি যা লিখলেন, তার মধ্যে এসব তেমন দেখা যায় না। যে-তসলিমা নিজেকে বলেন, ফেমিনিস্ট্র, অর্থাৎ নারীবাদী, সেই তসলিমা নারীদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা দূরে থাক, নারীদের জন্যে লিখলেনও না। বরং আত্মরতিতে তলিয়ে যাবার উপক্রম হলেন। তাঁর আত্মজীবনীগুলো দেশ অথবা দশের জন্যে নয়। তাঁর আত্মজীবনী সংকীর্ণ স্বার্থপরতারই স্বাক্ষর।