রোকেয়ার আর-একটি আশ্চর্য গুণ তাঁর অসাম্প্রায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি যখন লিখেছেন, তখন ভারতবর্ষের তাবৎ নারীদের সম্পর্কেই লিখেছেন। কৃষ্ণভাবিনীর সঙ্গে এখানে তাঁর একটা পার্থক্য লক্ষ্য করি। কৃষ্ণভাবিনী বেশ কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকেও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি স্বীকরণ করতে পারেননি। রোকেয়া মুসলিম সমাজের অন্তঃপুরে থেকেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধের কোথাও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ছাপ লক্ষ্য করি না। আর, পদ্মরাগী উপন্যাসে তিনি হিন্দু-মুসলমান-ধূস্টানের মিলিত যে-সংসারের চিত্র এঁকেছেন, তা তাঁর ঔদার্যেরই স্পষ্ট প্রকাশ। এমন কি, যে-যুগে মুসলমান সাহিত্যিকরা আরব-ইরানের খোয়াব দেখতেন, সেই কালে রোকেয়া লিখেছিলেন, “আমরা সর্বপ্রথমে ভারতবাসীতারপর মুসলমান, শিখ বা আর কিছু।”
রোকেয়ার পর শত শত নারী তাদের উন্নতির কথা লিখেছেন। এ যুগে তসলিমা নাসরিনের মতো অত্যাধুনিক নারীবাদীও আমরা দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা কট্টরপন্থী, যাঁরা কেবল নারীদের মুক্তি চান না, বরং অংশত পুরুষ-বিদ্বেষী। কিন্তু বাঙালি কোনো নারীবাদী এখনো পর্যন্ত রোকেয়ার মৌলিক চিন্তাকে ছাড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয় না। কোনো কোনো বিষয়ে রোকেয়ার ওপর সময়ের ছাপ দেখতে পাই। যেমন, তিনি যে-যুগে লিখেছিলেন, তখন যৌনমুক্তির কথা তাঁর পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিলো না। সন্তান গ্রহণে নারীদের সিদ্ধান্তই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত–এ কথাও তিনি লেখেননি। এমন কি, নারীবাদের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন–দেহ এবং অবরোধমুক্তির কথাও তিনি পুরোপুরি সমর্থন করতে পারেননি। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, বোরকার পক্ষে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু নারী চার দেয়াল এবং বোরকার আড়াল থেকে বেরিয়ে না-এলে কখনোই পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেন না–এ তিনি জানলেও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারেননি। কারণ, বোরকা নাপরলে তাঁর বিদ্যালয়ে তিনি হয়তো ছাত্রী পেতেন না। নয়তো যিনি ধর্ম মানুষের তৈরি বলে এক সময়ে দাবি করেছেন, তিনি বোরকার সমর্থন করতে পারেন না। আমার ধারণা, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি ধর্মের দিকে খানিকটা ঝুকেছিলেন। তাঁর নারীবাদী লেখার সংখ্যা তখন খুব কমে এসেছিলো। এ রকমের ছোটোখাটো বিষয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করি ঠিকই, কিন্তু বাংলায় নারীবাদী চিন্তায় তাঁর অবদান আজও অন্যদের চেয়ে বেশি।
————-
* প্ৰসঙ্গত বলা দরকার, রোকেয়া কখনোই নিজের নাম বেগম রোকেয়া লেখেননি। আমাদেরও লেখা উচিত নয়। আর, তাঁর মৃত্যু তারিখ আমাদের জানা আছে। কিন্তু জন্মতারিখ কোথাও লেখা নেই। এমন কি, তার জন্ম যে ১৮৮০ সালেই হয়েছিলো, তারও কোনো প্রমাণ নেই।
(প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২০০৬)
০৪. তসলিমার ভালোমন্দ
শুরুতেই সালাম সংগ্ৰামী তসলিমাকে–যে-তসলিমা জীবনের ঝুকি নিয়েও বারবার নিজের বক্তব্য চীৎকার করে প্রকাশ করেন; সমাজ, সংসার, ধর্ম এবং প্রচলিত মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করে নিজের পথে চলেন।
এমন কালাপাহাড় বলেই তাঁর নাম সবার মনেই এক রাশ আবেগ সৃষ্টি করে। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য হলো: পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর ধর্ম। তবে পুরুষই প্রধান লক্ষ্য তাঁর। পুরুষরা যেহেতু ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং নরকের ভয় দেখিয়ে নিজেদের সুবিধেটা বহাল রাখে, সে কারণে ধর্মও। পুরুষদের বিরুদ্ধে জেহাদ করেন বলেই তাঁর নাম শুনলেই পুরুষরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এমন কি যে-পুরুষরা আপাতদৃষ্টিতে উদারপন্থী, তারাও। আর ধর্মব্যবসায়ীদের তো কথাই নেই। বস্তুত, তসলিমার ধর্মবিরোধী কথাবার্তা শুনে তারা রীতিমতো জঙ্গী হয়ে ওঠেন। আইনের অপেক্ষা রাখেন না তারা। নিজেরাই বিচারক সেজে তারা তার গলা কাটার ফতোয়া দেন। তার পক্ষে যারা, তাদের সংখ্যাও কম নয়, তারাও আবেগে আত্মহারা হন কখনো কখনো, যুক্তিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তারা এতোটা যুদ্ধংদেহি নন। এই যা! পার্থক্যটা মাত্রার, প্রকৃতির নয়।
আর-কিছু লেখার আগে নিজের পরিচয় দিয়ে নিই। আমি নারীবিদ্বেষী নই। বরং মেয়েরা যে মানুষ এবং পুরুষের চেয়ে কোনোক্রমে ছোটো নন, তত্ত্বত কেন, মনেপ্ৰাণে এটা বিশ্বাস করি। সেই নির্যাতিত মহিলাদের অধিকারের কথা অমন তলোয়ার হাতে যিনি লিখেছেন, তাঁকে তাই সালাম না জানিয়ে পারিনে। তা ছাড়া, আমি ধর্মনিরপেক্ষতার কট্টর সমর্থক হিশেবেও তসলিমার ভক্ত। হাজার মাইলের দূরের মন্দির ভাঙার জন্যে যখন ভোলার নিরপরাধ হিন্দুদের বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছিলো, ধর্ষণ করা হচ্ছিলো হিন্দু নারীদের, তখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাঁর প্রতিবাদ করেছিলেন তসলিমা। হোক না অতি তুচ্ছ একটি উপন্যাস লিখে! সাহিত্য হিশেবে সেই উপন্যাস উপন্যাস হয়েছিলো কিনা, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। অন্য কেউ তো সেই বলাৎকারের প্রতিবাদ করেননি! তাই তসলিমার অকুণ্ঠ প্ৰশংসা না-করে পারিনে।
এখানে শেষ করতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু তসলিমার প্রতি আমার এই শ্রদ্ধা সম্প্রতি অবিচল রাখা একটু কঠিন হয়ে পড়ছে। সে কি আমারই ভুলে, নাকি তাঁর সাম্প্রতিক লেখা বুঝতে পারছিনে বলে, ঠিক জানিনে।
কলম হাতে নিয়ে প্রথমেই তসলিমা লিখেছিলেন কবিতা আর কলাম। প্রথম দিকে দুটোরই লক্ষ্য ছিলো পুরুষশাসিত সমাজে মহিলারা কতোভাবে অত্যাচারিত হন, চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখানো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, একই কথা বারবার লিখছেন কেন? ওতে পুনরাবৃত্তির দোষ হয় না? তিনি বলেছিলেন, ‘নারীর প্ৰতি অত্যাচার তো কমেনি। যতোদিন এ অত্যাচার চলতে থাকবে, ততোদিন লিখতে থাকবো।” যতোদিন তিনি দেশে ছিলেন, তার লেখা থেকে তাই মনে হতো। তিনি নারীনির্যাতনের কথাই লিখেছেন ততোদিন। তাঁর কলামে সেসব কথা তিনি লিখেছেন। ফেনিয়ে ফেনিয়ে। কিন্তু কবিতায় সেই একই কথা লিখেছেন, ছন্দের বন্ধনে, খানিকটা সংযমের শাসনে। কলামগুলোর চেয়ে তার এই কবিতা সে জন্যে আমার অনেক ভালো লাগে।