- বইয়ের নামঃ নারী ধর্ম ইত্যাদি
- লেখকের নামঃ গোলাম মুরশিদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. দেবতার নারীবন্দনা
ভাবতেই পারতাম না, গরুর চেয়ে উপকারী কোনো জন্তু থাকতে পারে। কিন্তু সেদিন কাক-ডাকা ভোরে এক দিব্যজ্যোতি দেবতা এসে উদাত্ত কণ্ঠে বললেন, “বৎস, গরুর চাইতে উপকারী জন্তু পশুপতি। অবশ্যই সৃষ্টি করিয়াছেন। তাহাকে চিনিতে পারিতেছ না? চক্ষু থাকিতেও তুমি অন্ধ। একবার নয়ন মেলিয়া চাহিয়া দেখো। দেখিতে পাইবে, তোমার গৃহেই গরুর চাইতে বহু গুণে উপকারী একটি জন্তু মনুষ্যরূপ ধরিয়া বাস করিতেছে। আমি তোমাদের গৃহলক্ষ্মী–নারীদের কথা বলিতেছি।”
এই দিব্যজ্যোতি দেবতা যে মহাদেব নন, তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তবু তাঁকে খুশি করার জন্যে (তেল দিলে কে না খুশি হয়!)। আমি বললাম, “দেবাদিদেব! আপনি এ কি বলছেন? গরু তো পশু নয়–গরু হলেন গোমাতা! না, ভুল বললাম! মাতার মাতা। কারণ মা সন্তানকে দুধ দেন মাত্র কয়েক মাস। অপর পক্ষে, গরু আমাদের দুধ দেয়। সারা বছর, সারা জীবন। আর, খাদ্যপ্ৰাণের কথা বিবেচনা করলে দুধ হচ্ছে সব খাবারের শ্ৰেষ্ঠ। তদুপরি, এই দুধ দিয়ে দৈ, সন্দেশ, রসগোল্লা-সহকতো রকমের অতি সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়। আপনি হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন, নোবেল প্ৰাইজ পাওয়া এক বাঙালি কবি কোনো এক দোকানের দৈ খেয়ে এমন মোহিত হয়েছিলেন যে, তাকে পয়োধি বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। প্ৰভু, আপনি আপনার অভিমত রিভাইজ করুন।”
দেবতা বললেন, “তোমার বক্তব্য একেবারে যুক্তিবর্জিত, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু পূৰ্ণ মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করো। তাহা হইলে গরুর তুলনায় নারীদের শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্যই দর্শন করিতে পরিবে। গরু দুধ দেয় বটে, কিন্তু তাহার শিং আছে। অনেক সময় সে মাথায় ঝাকুনি দিয়া গুঁতাইতে আসে। অনেক সময় দোহন করিবার সময় পা তুলিয়া ঝটিকা লাথি মারে। কিন্তু মানুষের অর্থাৎ পুরুষের শত অত্যাচার সহ্য করিয়াও নারী কখনো গুঁতাইতে আসে না। অথবা লাথিও মারে না। প্রয়োজনমতো গুঁতাইলে তোমাদের দেহ ঝাঁঝরা হইয়া যাইতো। লাথি দিলে। লাথি খাইতে খাইতে তোমাদের হাড় ভাঙিয়া গুড়া হইয়া যাইতো। তুমি চাটুকারিতা করিয়া আমাকে দেবাদিদেব বলিয়াছ বটে, কিন্তু আমি তাঁহার আজ্ঞাবাহী দাস মাত্র। আসল দেবাদিদেব উত্তমরূপে জানিতেন যে, মনুষ্যজাতি অর্থাৎ পুরুষকুল কি অসম্ভব কৃতঘ্ন এবং বদমাশ। নারীরা তাহাদের সমান হইলে অথবা তাহাদের ব্যবহারের উপযুক্ত উত্তর দিলে পুরুষ জাতি পুনঃপুন ভস্ম হইয়া যাইতো। কিন্তু তাহা হইলে মনুষ্য জাতিও বিলুপ্ত হইতো। অতএব তিনি ঠিক করিলেন যে, জানোয়ার-শ্রেষ্ঠ পুরুষদের জন্য ঢ়োড়া সাপের মতো নারী সৃষ্টি করাই নিরাপদ। কারণ এই সাপের বিষ নাই, তাহারা কামড়ায় না, এমন কি ঢুসঢাসও করে না।”
আমার স্বীকার করতেই হলো যে, হ্যাঁ, নারীদের মনের ইচ্ছা যেমনই হোক না কেন (তাদের সত্যিকার ইচ্ছার কথা দেবতারও জানা নেই), কিন্তু তাঁরা প্রকাশ্যে গুঁতোয় না অথবা পদাঘাতও করে না। কিন্তু তবু দেবতাকে বললাম, “যে-গরু কেবল দুধ দেয় না, তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার জন্যে নিজেদের দেহও দান করে; যে-গরু ফসল জন্মানোর জন্যে চাষবাসে আমাদের অশেষ উপকার করে; যে-গরুর গোবর খেয়ে মানুষের প্রায়শ্চিত্য করতে হয়; যে-গরুর গোবর সার এবং জ্বালানী হিশেবে ব্যবহার করা হয়; যে-গরুর শিং এবং হাড়ও ফেলার বস্তু নয়–আপনি সেই গোমাতাকে তুচ্ছ নারীর সঙ্গে তুলনা করছেন। দয়া করে বেয়াদবি বলে বিবেচনা করবেন না, কিন্তু হে প্ৰভু, আপনি আর-একবার বিষয়টা পুনর্বিবেচনা করে দেখুন।”
দেবতা বললেন, “তুমি বেয়াদবেরও অধম। দীর্ঘ জটিল বাক্য দিয়া এবং বাগাড়ম্বর করিয়া আমাকে ঠকাইবার ফন্দি আঁটিতেছ। ভাবিয়াছ পুরাকালের দেবতা আধুনিক লৌকিক ভাষার অর্থ ভালো করিয়া বুঝিতে পরিবেন না। ইহা তোমার ভুল ধারণা। (নোয়াখালির ভাষায়: বুল দারণা।) তুমি কেবল বেয়াদব নও, তুমি একটি গোমূর্খ। পাছে তুমি আমার কথা অনুধাবন করিতে সমর্থ না হও, সেই নিমিত্ত রামমোহন নামে তোমার এক পূর্বপুরুষের বাক্য দিয়া বুঝাইয়া দিতেছি। কোনো গরু তোমাদের দুই-তিন বেলা টক, মিষ্টি, ঝাল, কষায় ইত্যাদি বিচিত্র স্বাদের সুস্বাদু খাদ্য রাঁধিয়া দেয়? তোমার বাড়ি পাহারা দেয়? বরঞ্চ গরুকে পাহারা দিয়া রাখিতে হয়। গরু অতি ভোরবেলা হইতে মধ্য রাত্রি পর্যন্ত পুরুষকুলের সেবা করে? গরু কি তোমাদের সন্তানাদি লালন-পালন করে? তোমার প্রতিবেশিনীর সঙ্গে যখন ঝগড়া লাগিয়া যায়, তখন কোনো গরু কি কোমরে কাপড় প্যাঁচাইয়া তোমার হইয়া গলা ফাটাইয়া শ্রাবণের ধারার মতো গালি বর্ষণ করে? তুমি, নরাধম এবং চরম নেমকহারাম, সেই কারণে গরুর সহিত নারীর তুলনা করিতেছ। নারী গরুর তুলনায় সহস্ৰ গুণ উপকারী।”
দেবতা যেসব পয়েন্ট উত্থাপন করলেন, তার মধ্যে দু-একটার কথা সত্যি সত্যি আমি আগে থেকে চিন্তা করিনি। সে জন্যে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যুক্তি খণ্ডন করার মতো কথা খুঁজে পেলাম না। তা সত্ত্বেও বললাম, “হে তাত! আপনি যা বলছেন, তা হয়তো ঠিকই। কিন্তু নারীর চামড়া কোনো কাজে লাগে, বলুন! অথচ গরুর চামড়া–মহা উপকারী বস্তু।”