শ্রাবণী এক একজনের দিকে আড়চোখে চাইছে, মানে, এক একজন মহিলার দিকে। আর তৎক্ষণাৎ + চিহ্ন-সেঁটে দিচ্ছেন। এক দুই করে সবার গায়েই দেখলেন,—চিহ্ন আঁটা। কেবল একজনের গায়ে শ্রাবণী খুব অবাক হয়ে দেখলেন, বয়স বোঝা যাচ্ছে না। চল্লিশও হতে পারে। কিংবা কম। পুরুষ্ট গা হাত পা শুধু নয়, বেশ মোটার দিকে। সাদা শাড়ি-ব্লাউজ এর গা বেয়ে না দেখা একটা খাই খাই গন্ধ উঠে আসছিল। অনিলের খুব কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার ভেতর আড়ে আড়ে শ্রাবণীকেও দেখে গেলেন—আমার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছে নাকি? শ্রাবণী মনে মনে বিড়বিড় করলেন—ওই তো ছিরি। আমার এই স্লিম ফিগারের পাশে, ওই টপ মার্কা চেহারা। দাঁড়াতে পারবে? সাহস আছে বলতে হবে।
খুব গভীর গোপন চিন্তার ভেতরেই শ্রাবণী হঠাৎ হোঁচট খেলেন—স্লিম ফিগার। আমার? কিন্তু ওই স্লিম ফিগারকে তো অনিল ইদানীং তেমন করে চাইছিল না। তেমন করে কেন? চাইছিলই না তো। মুখে না বললেও, আমি কি বুঝিনি? আমাতে কি অরুচি এসেছিল। ‘অরুচি’ শব্দটা কোথা থেকে যেন একদলা বমি নিয়ে এল। শ্রাবণী এখন খুব শক্ত। এতটুকুও বমি না করে ড্যাবড্যাব চোখে দেখলেন, সাদা শাড়ি ব্লাউজের সারা গায়ে + চিহ্ন, + চিহ, আর + চিহ্ন।
হেরে যাবার কান্না কাদলেন। মনে মনে। অনেকক্ষণ ধরে।
এখন অনেক রাত। গভীর রাতে গোপন কান্নারা খুব সহজে বেরিয়ে আসে। শ্রাবণীর বেলায় তেমন কিন্তু হল না। হাসপাতালেই কান্নার কোটা বোধহয় শেষ করে এসেছেন। সেই শেষ বিকেল থেকেই ভেবেছিলেন, লুকোনো সতীন এতক্ষণ পাকড়াও হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। + চিহ্ন মার্কা সাদা শাড়ি বেশ ভালো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দুটো হাত ধরে কেমন বললেন, শ্রাবণী দেখা হল। কিন্তু বড্ড অসময়ে। অনিলদা ভালো হয়ে উঠুক। তোমাদের আমি বোয়াল মাছের পাতুরি খাওয়াব। খেয়েছ? কোন ভয় নেই। তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। এমন মেয়েকে বেশি দিন কষ্ট পেতে হবে না। চলি। ভালো থাকবে। খুব ভালো।
সতীন খোঁজার সব রাস্তাগুলোই বন্ধ। কোন মেয়ে কি সতীন হতে চায়? কেউ নয়। কেউ নয়। মেয়েরা তো মেয়ে। অনেক ঘেরাটোপ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে।
সেই ঘেরাটোপ খুলে একদিন তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। চেতলার ‘ফুলছাদ’ থেকে বেহালার একতলার বাড়িতে। অনেকগুলো সিঁড়ি নামতে হয়েছিল। কম বয়সের উচ্ছাসে নেমে আসাটা সেদিন চোখে পড়েনি। বেহালার বাড়িও ধীরে ধীরে তিলা করেছিলেন। এখানেও ফুল ফুল সবই আছে। তবে…, আজ এই বয়সে এসেও শ্রাবণীর মনে হল,—ওগুলো বোধহয় প্লাস্টিকের নকল ফুল। জাঁক আছে। কিন্তু ফুলের হৃদয়ের গন্ধ কোথায়? চারপাশ ঘিরে যা কিছু করেছি সবটাই কি এমন হৃদয়হীন? জাঁকসর্বস্ব। তা না হলে…।
অনেক কান্না, অনেক হেঁচকি। কতবার নাক মোছার পর শ্রাবণী দেখলেন, ড্রেসিং টেবিলটার একেবারে যা তা অবস্থা। এখানে ওখানে ছেঁড়া কাটা চুল। আবছা ঝুল। সারা ড্রেসিং টেবিলটা জুড়ে একটা নোংরা আস্তরণ। একবার ভাবলেন, পরিষ্কার করবেন। কিন্তু না, থাক। কি হবে? ভাবতে ভাবতে কি যেন চোখে পড়ল।ওগুলো কি? কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন। গোল গোল করে কাটা দু’টুকরো শশা। আধপচা, প্রায় শুকনো শশার টুকরো দুটো আরও গোস্লা পাকিয়ে গেছে। ঠিক যেন দুটো পচা চোখ।
অনের রাতের অনেক কান্নার শেষে, হাতের তেলোয় ধরা গোল্লা পাকানো শশা দেখতে দেখতে শ্রাবণী ফিসফিস করে নিজেকে বললেন,—এমন পচা চোখ নিয়ে সতীন খুঁজে বেড়াব? মা গো!
রাত বয়েই যাচ্ছিল।