শ্রাবণী নিজেও জানেন না। জানেন না? হয়তো জানেন। কিন্তু এ মুহূর্তে কোন কিছুই তো ঠিকঠাক কাজ করছিল না। শ্রাবণী তাই বুঝতেই পারলেন না, নিজেকে বড় বেশি একা পেতে চাইছেন। একদম একা।
ঘড়ির সর-সর। তারপরই ঢং ঢং করে দশটা বাজল। ঘড়ির শব্দে চমকে উঠেছিলেন। কী চুপচাপ! ঘরটা। এত শব্দে ঘোর কেটে গেল। দরজা খোলা। আলোটাও জ্বলছে। সেই জ্বলা আলোয় দেখলেন—ইস। এঁটো ব্যাগটা এখনও খাটেই রেখে দিয়েছি। অনিলের টিফিন নেওয়া কাঁধে ঝোলানো সেই ব্যাগটা।
অলস হাতে নামিয়ে রাখতে গিয়েও বুকের কাছে নিয়ে এলেন।—এমা! টিফিন কৌটো তে ভর্তি। খায়নি।
না খাওয়া টিফিন কৌটো। বার করলেন। একটা ঠোঙা।ঠোঙা আবার কিসের? আঙুরে ভরা ঠোঙা বেরিয়ে এল।—ভরা নয়তো। কে যেন অনেকগুলো
খেয়ে নিয়েছে। এই তো। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এখান ওখান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া। অনিল টিফিন না খেয়ে আঙুর খেয়েছে?
দুপুর দুটোর গরম রাত দশটায় অনেকটা নেমে এসেছে। মাথার ওপর বন বন করে ফ্যান ঘুরছিল। তাও…, শ্রাবণী দেখলেন, তাঁর গলা বেয়ে ঘামের একটা দাগ দরদর করে নেমে যাচ্ছে। হাত দুটো কি কেঁপে গেল? সেই কঁপা হাতে শ্রাবণী আবিষ্কার করলেন। ব্যাগের এক কোণে, গোপাল বড় সুবোধ ছেলের মুখ নিয়ে এক প্যাকেট কনডোম শুয়ে রয়েছে। পুরো প্যাকেট তো নয়। কেউ যেন একটা ছিঁড়ে নিয়েছে। একটা ভয়ংকর বরফের টুকরো শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ডে ঝাঁপটা মারল। ঝাঁপটা? না ছোবল। নিমেষের ভেতর সেই সাপের কিলবিলানি শ্রাবণীর পা থেকে মাথার স্নায়ু পর্যন্ত উঠে এসে, ক্লান্ত এই মহিলাকে অসাড় করে দিল।
—আঙুর! কনডোম! অনিল তো কোনদিন এসব জানত না। ফলের ভেতর, আম, পেঁপে আর সবেদা। এই তো খায়। কনডোম নিয়ে কত হাসাহাসি। পরতে গেলেই সময় নষ্ট। সেই লোকের ব্যাগে…। কে শেখাল?
শ্রাবণী কাঁদছেন। নিঃশব্দ। আকুল। সর্বস্বান্ত হওয়ার তীব্র ভয় মেশানো সেই কান্না। কী আশ্চর্য। শ্রাবণী বুঝতে পারছেন না কেন। তবুও এই নষ্ট মুহূর্তে টকটক করে কত সুন্দর সব ছবি উঠে আসছিল। বিয়ের আগের দোকানের সেই লাজুক অনিল। মায়ের ‘ফুলছাদ’ দেখে বলেছিল, এত উঁচু ছাদেও এমন বাগান হয়। এর পরে তো আকাশেও বাগান হবে। বেহালার অন্যতম আদি, ‘লক্ষ্মী শাড়ি সংসার’, বিয়ের পরপরই কেমন ‘শ্রাবণী শাড়ি এম্পোরিয়াম’ হয়ে গেল। যা চেয়েছি তাই হয়েছে। চাইতে তো হয়নি। না চাইতেই সব কিছু পেয়ে গেছে। তুমি যে বড় পোবমানা। আমার হিস্ট্রিতে অনার্স। তোমার কি অনিল? মনে আছে? কেমন মজার মুখ করে বলত,দোকান মালিক হব। আর হিসেব শিখব না? সেই জন্যেই তো পিতাঠাকুর পাশ কোর্সের বি.কম বানিয়ে দোকান ফিট করে দিল। তোমাদের বাড়ির জলখাবার আমার বিয়ের পরেই কেমন ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল! মনে পড়ছে? কি হল? বলো না। মনে পড়ছে? মনে পড়ছে।
একটা ‘গোঁ’-এর ভেতর থেকে এক কথা বারবার বলে চলেছেন। শ্রাবণীর কি খেয়ালে রয়েছে। অনিল এখন হাসপাতালের আই সি সি ইউতে? বাঁচবে কি বাঁচবে না ডাক্তাররাও জানেন না।
শ্রাবণীর খেয়ালই নেই। তিনি সেই তখন থেকে নিজের হেরে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়েই চলেছে। কার সঙ্গে? জানেন না। তবু এই লড়াই লড়ছে—আজ শশা দিয়ে শখের দাগ উঠিয়েছি। কার জন্যে। বল? কার জন্যে? তোমাকে ‘শ্রী’ থেকে ‘মিস্টার’-এ উঠিয়েছে কে? জান না? শুয়ার। বাটামাছের ঝোল না খেয়ে আঙুর খাওয়া হয়েছে? কার সঙ্গে রে? পোষমানা কুকুর? শ্রাবণী হাঁপালেন। শ্রাবণী কাঁদলেন। শ্রাবণী বোধহয় শুয়ে পড়লেন। দুঃখের কান্নার ভেজানো সেই সুখের বালিশ-এ। রাতের পর সকাল আসে। জাপানে আসে। সাইবেরিয়ায়। বেহালাতেও এসেছিল। বেহালার সকাল, সকাল সকাল এসে দেখল, শ্রাবণী দাঁতও মেজে একদম তৈরি।
শ্রবণা বলল, মা তুমি যাচ্ছ? আমি যাব? শ্রাবণী হাসলেন। সে হাসিতে আনন্দ মজা কিছু ছিল না। শুধু ক’খানা দাঁত বার করতে হয়, তাই। মুখে বললেন, অনার্স ক্লাশগুলো করে আয়। আমি তো থাকবই। মনে মনে খুব বিশ্রিভাবে হাসলেন। সেই খ্যানখেনে হাসির ভেতর, মনে মনেই বেরিয়ে এল, আমি তো যাচ্ছি সতীনের খোঁজে। মায়ের সতীন দেখতে তোর ভাল লাগবে?
শ্রবণা অনেকক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে কি যেন খোঁজবার চেষ্টা করল, খুঁজে পায়নি। আজ তিনদিন। শ্রাবণী আসেন। আই সি সি ইউ-এর বাইরে এই টুলটায় ঠায় বসে থেকে লক্ষ করেন, অনিলকে দেখতে কে এল। এসেছে অনেকে। তবে মহিলা বিশেষ নয়। যারা এসেছিল সবাই তো কাছের আত্মীয়া। আজ দুপুর বেলা হঠাৎ শ্রাবণী জানেন না কেন, সেই ছেলে দুটোর কথা খুবই মনে হল—-ওদের ঠিকানা রাখলেই হত। ওরাই তো ব্যাগ খুলে বাড়ি আর দোকানে ফোন করেছিল। আচ্ছা, কনডোম দুটো কি ওদের চোখে পড়েছিল? ওরা কি দেখেছে? অনিল যখন মাথা ঘুরে পড়ে যায় তখন কেউ ওর পাশে ছিল কি না? ইস বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এখন সতীনকে কোথায় খুঁজে পাই…? টুলের উপর চুপটি করে বসে, শ্রাবণী মনে মনে বকবক করেই চলেছেন।
শ্রবণা এসেছিল। বাবাকে দেখে গেছে।—সেই একই। মাকে ওঠাতে পারেনি। সন্ধ্যায় আবার আসবে বলে ফিরে গেছে। বিকেল শেষের আগে এক দঙ্গল এলেন। মহিলাই বেশি। শ্রাবণী এঁদের চেনেন না। শাড়িব্লাউজ মাখানো পারফিউমের গন্ধে হাসপাতালের ওষুধ গন্ধ উধাও। সবার পেছনে মল্লিকবাবু ধীর পায়ে উঠে এসে বললেন, এঁরা বেহালা বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিত্রি সব কমিটি মেম্বার। অনিলের কথা শুনে খুব শোক পেয়েছেন। ‘শোক’ কথাটা কানে যেতে শ্রাবণী সবার হাতের দিকে তাকালেন-যাক বাবা! সন্দেশ কিংবা রজনীগন্ধা আনেনি।