পর্দা ফেলা জানলার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মনখারাপের বাতাস এসে শ্রাবণীকে নাড়িয়ে দিতে চাইছিল। উড়িয়ে।সত্যিই তো…। শ্রাবণীর মনে হল। ইদানীং তো ও সেই মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে হামলে পড়ে না। কেমন যেন গুটিয়ে থাকা পুরুষ। দোকান বড় হয়েছে। কর্মচারী বেড়েছে। কাজ। ক্লান্তি। সবই বুঝলাম। তা বলে…। আমি কি বুড়িয়ে গেছি? কি করে? এখনও তো ক্যালেন্ডারের দিন মেপেই মাসে মাসে ঐটে হয়ে যায়। ও কি বুড়ো হয়েছে? যাঃ, ছেচল্লিশ কি একটা বয়স? পুরুষমানুষের ছেচল্লিশ কোনও বয়সই নয়। তবে…?
…এমনিই এসে ভেসে যায়… শেষ হল। শ্রাবণী বিছানা ছাড়লেন। চোখের ওপর সেঁটে দেওয়া শশার টুকরো দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। খুব হাল্কা, তৃপ্ত, গর্বিত একটা হাসি ঠোঁটের কোণ বেয়ে উঠে আসছিল—আমি এখনও চোখে পড়ার মতন। চোখের কোণে কালিমারা কোথায়? ওরা ওই গানের সঙ্গে বুঝি ভেসে গেছে। ভালো লাগল। খুব ভালো।
সেই ভালো লাগা নিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেছেন আর গুনগুন করছেন।—এমনিই এসে ভেসে যায়…।
কি ভেসে যায়? কোথায় ভেসে যায়? কেন ভেসে যায়? খেয়ালই করছেন না। গুনগুন করে ভাসিয়েই দিচ্ছেন। সেই গুনগুনানির ভেতর ফোন এল।
একটা হাঃ হাঃ চিৎকার। তারপরই স্ব কিছু অন্ধকার।
ওষুধের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল। শ্রাবণী জানেন না। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক দেখার আগেই দুটি যুবক এগিয়ে এসে কি কথা যে বলেছিল, শ্রাবণী তাও জানেন না। দুটো শব্দ কানে কিল মেরেই চলেছে, হার্ট অ্যাটাক। একটি নার্সের পিছনে পিছনে আই সি সি ইউতে ঢুকলেন। অনিলের চোখ বোজা নাকে নল। মাথার কাছে দেওয়ালে ছোট্ট টিভি সেট-এর মতো মনিটরিং মেশিনটায় দুটো সরু সরু লাইন ভাঙছেগড়ছে, ভাঙছেগড়ছে করতে করতে বাঁদিক থেকে বেরিয়ে ডান দিকে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
নার্সটি গোপন কথা বলার ঢঙ-এ ফিসফিসিয়ে বলল, বাইরে চলুন। শ্রাবণী ফ্যালফ্যাল করে আবার দেখলেন, শব্দ না করে টিভি সেট-এর মতো মনিটরিং মেশিন, নল গোঁজা নাক। বোজা চোখ। বেরিয়ে আসতে হল।
নার্স বলল, আর কেউ আসেননি? একা? শ্রাবণীর মাথা নাড়া দেখে কিছু বুঝতে পারল না। বলল, এই টুলটায় বসুন। এখন ভিজিটিং আওয়ার নয়। ঠিক আছে, বসুন, নার্স চলে গেল।
নার্স চলে যেতে শ্রাবণী একা হয়ে গেলেন। কী ভীষণ একা। বাইরে কি এখন ট্রামবাস চলছে? লোকের ভিড়? গা-পোড়া রোদ্দুর? এ জায়গাটা এমন কেন? শীত শীত করা নির্জনে। হাসপাতালটার নাম কি যেন? এন.আর.এস.। এখানে নিয়ে এল কেন? ছেলে দুটো কি যেন বলছিল, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া..। শিয়ালদা স্টেশন। শিয়ালদায় কি করছিল? শ্রবণা কোথায়? ও কি জানে না, ওর মায়ের কত বড় বিপদ? এই সময় তুই পাশে থাকবি না? কেমন মেয়ে?
শ্রাবণী কোনও পথ পাচ্ছিলেন না। চিন্তার সব পথগুলোর মাঝখানে কে যেন ‘নো-এনট্রি’ বোর্ড লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কান্না পাচ্ছিল। ভয় হচ্ছিল। নিদারুণ সেই অসহায়তাকে শ্রাবণী এক ঢোকে গিলে ফেললেন। এখানে ঘড়ি নেই। শ্রাবণী ঘড়ি পরে আসেননি। সময় যে কতটা বয়ে গেছে বুঝতেই পারলেন না।
দুড়দাড় করে শ্রবণা উঠে এল। পেছনে মল্লিকবাবু আর দোকানের দুজন কর্মচারী। শ্রবণা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা। শ্রাবণী সেই নার্সটির নকলে ফিসফিসিয়ে বললেন, আস্তে। জোরে কথা বলো না। তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক। নাকে নল গুঁজে শুয়ে রয়েছে। আমার সঙ্গেও কথা বলেনি।
শ্রবণা মাকে দেখল। যা বোঝবার নিজেই বুঝল। কথা বাড়ায়নি।
মাঝে মাঝে গম্ভীর মুখের এক একজন ডাক্তার আই সি ইউতে ঢুকে যাচ্ছেন। অনিলের মুখের দিকে এক পলক চেয়েই, খাটের সঙ্গে লাগানো চার্টটায় চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে আসছেন। অনিলের চোখের পলক পড়ছে না। একই ভাবে বোজা। কাঁচের জানালার এপাশ থেকে শ্রাবণী সব কিছুই লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন।
সন্ধের মুখে দুজন কমবয়সি ডাক্তার একসঙ্গে ঢুকলে, শ্রাবণী কেমন যেন সাহস পেয়ে তাদের পেছনে পেছনে ঢুকে পড়লেন। তারা বেরিয়ে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা ও কখন কথা বলবে? দুজন ডাক্তারই একসঙ্গে থমকে গেল। একজন বলল, কথা? বলবে? অপরজন বলল,–হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলবে। তবে এখন তো…।
মল্লিকবাবু অনেকদিনের কর্মচারী। সেই শশুরের আমল থেকে। অনিলকেই নাম ধরে ‘তুমি’ বলেন। এতক্ষণ পর এগিয়ে এসে বললেন—বৌমা, এবার তুমি ওঠো। আমরা সকলে তো রয়েছি। কাঁধের ব্যাগটা আমাকে দাও। আমি তোমাদের পৌঁছে। দিয়ে আসছি।
ব্যাগটা অনিলের। হাসপাতালে ঢোকার মুখে সেই ছেলে দুটো শ্রাবণীকে দিয়ে যায়।
‘ব্যাগটা আমাকে দাও’, শুনে শ্রাবণীর দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। দুহাত দিয়ে ব্যাগ জড়িয়ে ধরে তীব্র গলায় বললেন—না। না। আমার কাছে থাক।
অমন হিংস্র হয়ে ওঠার দরকার ছিল না। শ্রাবণী এখন বেখেয়ালি। হঠাৎ বোধহয় ভাবলেন স্বামীকে কেউ কেড়ে নিতে চাইছে।
মায়ের মুখ-চোখের অবস্থা দেখে শ্রবণা আজ এই ঘরে শুতে চেয়েছিল। শ্রাবণী বড় বড় করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,—ওমা! না, না, ঠিক আছে। কিছু হবে না। সারাদিন তোর এত ধকল গেল। যা, শুয়ে পড়।
মেয়ে আড়চোখে মাকে দেখল।—কোথায় যেন অঙ্ক মিলছে না। নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।