মায়মুনা বলল, ভাগ্যবতী।
নওশের বলল, সত্যিই তুমি ভাগ্যবতী। তোমার নামের অসিলায় আমার দিব্যচোখ খুলে গেছে। তুমি মানবী নও। কোন মানবীর এত ধৈর্যশক্তি থাকতে পারে না। তোমাকে অবেহলা করে, তোমার উপর অত্যাচার করে আমি খুব অন্যায় করেছি। জানি আল্লাহ আমাকে মাফ করবে কিনা-এখন বল মায়মুনা, তুমি আমাকে মাফ করেছ?
স্বামীর কথা শুনতে শুনতে মায়মুনার মনে চির আকাঙ্ক্ষিত ধন পাওয়ার আনন্দ সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগল। সেও স্বামীকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, মাফ চেয়ে আমাকে গোনাহগার করো না। আমি মানুষ। আমারও অনেক দোষত্রুটি আছে। তুমি বরং আমাকে মাফ করে দাও। আর আমার প্রতি তুমি যা কিছু করেছ, তাতে আমি মানবিক কারণে অনেক সময় অসন্তুষ্ট হলেও সেসব মনে রাখিনি। তুমি আল্লাহপাকের হুকুম অমান্য করে অনেক অন্যায় করেছ। তাই বলব, তওবা করে তাঁর কাছে মাফ চাও। তিনি রাহমানুর রাহিম। বান্দাদের তওবা কবুল করে থাকেন।
নওশের বলল, মায়মুনা তুমি সত্যি আল্লাহর খাস বান্দী। এই তোমাকে জড়িয়ে ধরে আজ থেকে সবকিছু ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা করে তওবা করছি, জীবনে আর কোনদিন আল্লাহর হুকুম অমান্য করব না।
মায়মুনা প্রথমে বলল, আমিন! তারপর শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আল্লাহ গো, তুমি আমার স্বামীর তওবা কবুল কর।
সেদিন থেকে নওশেরের জীবনযাত্রার পরিবর্তন শুরু হল। সব রকমের নেশা ছেড়ে দিল। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিল। অবসর সময়ে ধর্মীয় বই কিনে পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে নামায পড়তে শুরু করল।
বন্ধুরা তার পরিবর্তন দেখে তার কাছে এসে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য নিয়ে যেতে চেষ্টা করল। সফল হতে না পেরে তারা আস্তে আস্তে যাতায়াত বন্ধ করে দিল। শুধু বিমল ও সুখেন্দু নামে দুজন হিন্দু যুবক মাঝে মাঝে আসত। একদিন তারা জিজ্ঞেস করল, তোর এই পরিবর্তন হল কি করে বলবি? :
নওশের বলল, সে কথা পরে বলব। তারপর গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইটা একজনের হাতে দিয়ে বলল, এটা তোরা পড়।
বিমল ও সুখেন্দু দুজনেই এম.এ.। দুজনেই মহেশবাথান হাইস্কুলের শিক্ষক। বিমল ইংলিশের আর সুখেন বাংলার। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা বইটা ফেরত দেয়ার সময় বলল, বইটা পড়ে তোদের ধর্ম ও ধর্ম প্রবর্তকের জীবনী সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
নওশের বলল, কি জানলি, ভাল না মন্দ?
বিমল বলল, যে কোন ধর্মের আইন-কানুন সব ভাল।
সুখেন্দু বলল, যে কোন ধর্মের প্রবর্তকের চরিত্রও উত্তম।
নওশের তাদের সাহাবা চরিত বইটা দিয়ে বলল, এটাও পড়ে দেখ।
সাহাবা চরিত পড়ে তারা ফেরত দিতে এসে বলল, এত উন্নত চরিত্রের নমুনা আমাদের ধর্মগ্রন্থে নেই।
নওশের বিমলকে আল্লামা ইউসুফ আলির কুরআনের ইংলিশ ট্রানস্লেট দিল। আর সুখেন্দুকে আব্দুল হাই ও আলি হোসেনের বাংলা অনুবাদ দিয়ে বলল, এগুলোও পড়।
কুরআন ব্যাখ্যা পড়ে তাদের মন ইসলামকে আরো জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। তারা নওশেরের কাছ থেকে আরো বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় বই নিয়ে পড়তে পড়তে ছমাসের মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। শুধু তারা নিজেরা নয়, তাদের বাড়ির সবাইকে নিজেদের মতামত জানিয়ে দুজনের বাড়ির সবাইকে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করল।
বিমল ও সুখেন্দ, শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ক্ষান্ত রইল না। নওশেরের কথা মতো পীরের মুরীদ হয়ে তিন বন্ধুতে মাত্র দুতিন বছরের মধ্যে তরীকতের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেল।
নওশেরের ডিসপেনসারীর আলমারীতে এখন ওষুধের চেয়ে হাদিস ও অন্যান্য ধর্মীয় বই বেশি। তিন বন্ধু সংসারের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম ছাড়া সব সময় হাদিস কেতাব অধ্যয়ন করে, আর রাত জেগে আল্লাহ পাকের ইবাদত করে।
মায়মুনা সবকিছু দেখেশুনে কেঁদে কেঁদে আল্লাহপাকের শোকর গুজারী করে।
৩. চাচাত ছোট মামা ফজলুল
নাদিম তার চাচাত ছোট মামা ফজলুলের সঙ্গে পড়ে। ফজলুল নাদিমের চেয়ে তিন-চার বছরের বড়। কিন্তু সে প্রতি ক্লাসে এক বছর করে ফেল করে করে যে বছর। ক্লাস এইটে ফেল করল, সেই বছর নাদিম ক্লাস এইটে উঠল। মামা ভাগ্নে হিসাবে আগে যতটা সুসম্পর্ক ছিল, ক্লাস এইটে উঠে সেটা আরো বেড়ে গেল। তার মুখে নাদিম নওশের খালুর পরিবর্তনের কথা শুনে ফজলু মামার সাথে দুতিন বার তাদের বাড়িতে তাকে দেখতে গিয়েছিল। নাদিম যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন তার এই নওশের খালু একবার তাদের বাড়িতে এসেছিল। সেদিন নাদিম স্কুল থেকে ফিরে নওশের খালুকে দেখে কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, খালু কেমন আছেন?
নওশের সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তা বাবাজী স্কুল থেকে এলে মনে হচ্ছে, কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস নাইনে।
আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভাল, শুনে খুশি হলাম। এমন সময় আযান শুনে বলল, তুমি তো নামায পড়; মসজিদে চল-আযান হচ্ছে।
নামায পড়ে নাদিম তাকে বলল, খালু, আমি আপনাদের ওখানে দুতিনবার গিয়েছি। আপনার ডিসপেনসারীতে অনেক বাংলায় হাদিসের বই দেখেছি। আমাকে পড়তে দেবেন?
নওশের বলল, হাদিস পড়বে এটা তো খুব ভাল কথা, দেব না কেন? তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে নিয়ে এসে পড়।
তারপর থেকে নাদিম স্কুলে যাওয়ার নাম করে খালুর কাছে গিয়ে সারাদিন ডিসপেনসারীতে বসেবসেহদিস পড়ত। বিকেলে স্কুল ছুটির সময় নিয়মিত ঘরে ফিরে আসত।