নওশেরের ঘুম পাতলা হয়ে এসেছিল। মায়মুনা আঁচল দিয়ে গাল মুছে দেয়ার সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাকিয়ে মায়মুনাকে পাশে বসে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার-কাঁদছ কেন? মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমোওনি।
মায়মুনা চোখ মুছে বলল, না এমনি একটু। তারপর কয়েক সেকেণ্ড বিরতি দিয়ে আবার বলল, গত রাতে বাসায় ফিরে তুমি বমি করছিলে। তোমার শরীর খারাপ দেখে ঘুম আসেনি। তাই বসে বসে তোমার মাথায় বাতাস করছিলাম।
নওশের ঘরের মেঝেয় নতুন জামা-কাপড়ের স্তূপ দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, ওগুলো ঐরকম অবস্থা হল কি করে?
তুমি নেশার ঘোরে করেছ। তারপর বমি করে ঘুমিয়ে পড়েছ।
নওশের খুবই আশ্চর্য হয়ে বলল, সত্যি বলছ, আমি ঐ সব করেছি?
আমাকে কি কোনদিন মিথ্যে বলতে শুনেছ?
নওশের অনেক্ষণ মায়মুনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ভাবান্তর হল। বলল, কাল খুব শখ করে ঐসব জামা-কাপড় কিনেছিলাম। যখন আমি ঐগুলো নষ্ট করছিলাম তখন বাধা দিলে না কেন?
আজ চার বছরের মধ্যে তোমার কোন কাজে বাধা দিয়েছি কি?
নওশের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার যে ভাবান্তর শুরু হয়েছিল এখন তার কথা শুনে মনের মধ্যে অনুশোচনার উদ্রেক হতে শুরু করল। তখন তার বিগত দিনের কথা মনে পড়তে লাগল।
নওশের অবস্থাপন্ন বাবার তৃতীয় সন্তান। আই.এ. পাস করে হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী নিয়ে প্রথমে নিজেদের গ্রামে প্র্যাকটিস শুরু করে। বছর খানেকের মধ্যে বিয়ে করে শ্বশুরের টাকায় মহেশবাথানে ডিসপেনসারী করেছে। মেয়ে কাল বলে শ্বশুরের কাছে যখন যা আবদার করেছে তিনি তা দিয়েছেন। তবু নওশের স্ত্রীকে ভালোবাসা তো দূরের কথা তার সঙ্গে এতটুকু ভাল ব্যবহারও করেনি। সব সময় অবহেলা করে এসেছে। স্বজ্ঞানে কোনোদিন তার সঙ্গে দৈহিক মিলনও করেনি। অথচ মায়মুনা কোনদিন ভুলেও তার প্রতি কোনো কটুবাক্য বলেনি, কোনদিন রাগ করেও কিছু বলেনি। সব সময় মধুর ব্যবহার করে এসেছে। কোন কোনদিন নেশার ঘোরে কত অত্যাচার করেছে, তার শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে, কখনো টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। আশ পাশের বাসার কাউকে স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা এতটুকু জানতে দেয়নি। দেশ থেকে বাপ ভাই অথবা আত্মীয় স্বজন কেউ এলে তাদের কাছে হাসিমুখে থাকে। এমনভাব দেখায় যেন স্বামীর কাছে কত সুখে আছে। অথচ সে খুব ধনী ঘরের মেয়ে। ইচ্ছা করলে বাপ-ভাইকে স্বামীর অত্যাচারের কথা বলে ছাড়কাট করিয়ে নিতে পারত। অশিক্ষিতও নয়। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছে। হঠাৎ নওশেরের মনে হল, এই মেয়ে কি মানবী, না অন্য কিছু? মানবী না হলে এতদিন এতকিছু সহ্য করেছে কি করে? কোনদিন তার মুখে বিরক্তি, বিষাদ কিংবা রাগের চিহ্ন দেখেনি কেন?
তার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, তোমার স্ত্রী মানবী। এতদিন ঘর করছ অথচ তাকে বোঝার চেষ্টা করনি কেন? তখন তার মনে হল, আমি ওর প্রতি এতদিন খুব অন্যায় ও অবিচার করেছি। এই সব ভাবতে ভাবতে অনুশোচনায় নওশেরের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
মায়মুনা বিয়ের পর থেকে স্বামীকে কোনদিন তার মুখের দিকে ভাল করে চাইতে দেখে নি, ভাল করে কথা বলতেও দেখেনি। ভেবেছে, সে কাল ও দেখতে খারাপ বলে এরকম করে থাকে। মায়মুনা মনে দুঃখ পেলেও বাইরে তা কখনও প্রকাশ না করে ভাগ্যের কথা ভেবে হাসিমুখে সব কিছু সবর করে চলেছে, আর মনে মনে আল্লাহর কাছে সবর করার তওফিক চেয়ে স্বামীর হেদায়েত প্রার্থনা করেছে। আজ স্বামীকে তার মুখের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেখে ও ভালভাবে কথা বলতে শুনে, খুশি হয়ে মনে মনে এতক্ষণ আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করছিল। এবার তার চোখে পানি দেখে বলল, তোমার কি কোন কষ্ট হচ্ছে?
নওশের কোন কথা বলতে পারল না, শুধু না-সূচক মাথা নাড়ল।
তা হলে তোমার চোখে পানি কেন-বলে মায়মুনা নিজের চোখের পানি মুছল।
মায়মুনাকে চোখের পানি মুছতে দেখে নওশের বলল, আমার কিছু হলে তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না?
মায়মুনা আজ স্বামীর আচরণে উত্তরোত্তর যত অবাক হচ্ছে তত তার মন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠছে। স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে সেও কোন কথা বলতে পারল না। আনন্দের আতিশয্যে তার গলা বুজে এল। চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, সেই অবস্থায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
নওশের বলল, কিন্তু কেন, কেন, কেন-বলে সে থেমে গেল। অনুশোচনায় তারও গলা বুজে এল। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি কি জান, আমি তোমাকে পছন্দ করি না, শুধু টাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি।
হ্যাঁ, জানি। আরো জানি, রসুল্লাহ বলিয়াছেন, যদি কোন ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির সিজদা করিবার আদেশ দিতাম, তবে আমি স্ত্রীকে বলিতাম তার স্বামীকে সিজদা করিতে। স্বামীর এতটুকু দোষ কোন মুমীন স্ত্রী ধরে না, ধরতে পারে না। সব সময় স্বামীকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে।
আর আমি যদি তোমাকে সারাজীবন পছন্দ না করে এভাবে কাটাই?
তবুও আমি তোমাকে সারাজীবন স্বামীর মর্যাদা দিয়ে কর্তব্য পালন করে যাব। ভাবব, আল্লাহ পাক আমার তকদিরে দুনিয়াতে স্বামীর সুখ রাখেন নি। মোমেনা বান্দী কোনদিন স্বামীর অমর্যাদা করে না। সে আল্লাহ ও তাঁর রসূল (দঃ) কে খুশি রাখার জন্য সবকিছু সবর করে সহ্য করে। আল্লাহ কুরআন পাকে বলেছেন, আল্লাহ সাবেরিনদের সঙ্গে থাকেন। নওশেরের দিব্যচোখ আল্লাহ খুলে দিলেন। তাই স্ত্রীর কথা শুনে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, মায়মুনা, তোমার নামের অর্থটা বলবে?