ইংলিশ স্যারের নাম জিয়াদ। তিনি ক্লাসে ভীষণ কড়া। কিন্তু অন্য সময় মাটির মানুষ। নাদিমের কথা শুনে বললেন, ক্লাসের সব ছেলে শুনতে পেল আর তুমি পেলে না, মন কোন দিকে ছিল?
সাবের নামে একটা ছেলে বলে উঠল, স্যার, ও গল্পের বই পড়ছিল।
জিয়াদ স্যার শুনে রেগে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড কথা বলতে পারলেন না। তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, স্ট্যান্ডআপ অন দা বেঞ্চ।
সেদিন সারা পিরিয়ড নাদিমকে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হল। ক্লাস শেষ হতে জিয়াদ স্যার যাওয়ার সময় নাদিমকে বললেন, আবার যদি কোনদিন এই কথা শুনি তা হলে চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব।
এরপরও নাদিম ক্লাসে আউট বই পড়া বন্ধ করে নি। তবে জিয়াদ স্যারের ক্লাসে আর কোনদিন পড়েনি।
ক্লাস সিক্স, সেভেন ও এইটে পড়ার সময় নাদিমের পর পর তিন বছর টাইফয়েড় হয়। প্রতিবারই মরতে মরতে বেঁচে গেছে। শেষবারে ডাক্তার বলেছিল, এই ছেলে বেঁচে থাকলে হয় পাগল হয়ে যাবে, না হয় যে কোন একটা অঙ্গহানী হবে। কিন্তু তার কোনটাই হয়নি। তবে সে ভীষণ একগুয়ে ও রাগী হয়েছে। নিজের মতের বাইরে কোন কিছু করে না। জোর করলে অত্যন্ত রেগে যায়। আর তার কথা না শুনলে একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়ে। বড় হয়ে প্রচুর ধর্মের বই পড়ে ও ধর্মের অনুশীলন করে হঠাৎ রাগে না বটে, কিন্তু একবার যদি রেগে যায় তখন অঘটন ঘটিয়ে বসে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় একটা অঘটন ঘটিয়েছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখল, তার ইমিডিয়েট ছোট বোন ফৌজিয়া তালের আঁটি কেটে গজা করে বের করে খাচ্ছে। নাদিম বই রেখে এসে তার গজা চাইল। ফৌজিয়া বলল, আমারগুলো দেব না, তুই কেটে খা। নাদিম তার কাছে দা চাইল। ফৌজিয়া বলল, দাঁড়া, আমি আগে এইগুলো। কেটে নিই, তারপর দেব। নাদিম বলল, যেগুলো কেটেছিস, সেগুলো খা। আমার কাটা শেষ হলে তারপর তোরগুলো তুই কেটে খাস। ফৌজিয়া বলল, না আগে আমারগুলো। কেটে নিই। নাদিম তখন রেগে গিয়ে তার হাত থেকে দাটা কেড়ে নিয়ে তার মাথায়। এক কোপ বসিয়ে দিল। ফৌজিয়া ভয়ে নিজের মাথায় হাত দিয়েছিল বলে সে যাত্রা। বেঁচে গেল। নচেৎ তার মাথার ঘিলু বেরিয়ে পড়ত। দায়ের কোপ তার হাতের উপর পড়েছিল। ফলে অনেকটা কেটে গিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। ফৌজিয়া তখন বাবারে মরে গেলাম রে বলে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তার চিৎকার শুনে মা-চাচীরা ছুটে এল। ফৌজিয়ার অবস্থা দেখে তারা ডাক্তার আনতে পাঠাল। ডাক্তার এসে হাতের কেটে-যাওয়া জায়গাটা সেলাই করেছিল। নাদিম ভয়ে পালিয়ে যায়। রাতে ফিরলে তার আব্বা তাকে সেদিন ভীষণ মেরেছিল। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় এরকম এক ঘটনা। ঘটিয়েছিল, যা শুনলে প্রত্যেক মানুষ যেমন অবাক না হয়ে পারবে না, তেমনি তার একগুঁয়েমির পরিচয় পেয়েও অবাক হবে। এই ঘটনার সঙ্গে নাদিমের ছোট নানার সেজ জামাই নওশের জড়িত। তাই নওশেরের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে।
নওশের একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। দেখতে খুব সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান। মডার্ন যুবক। ধর্মকর্ম করা তো দূরের কথা, ধার্মিক লোকদের সে মোটেই দেখতে পারত না। ডাক্তার হিসেবে অল্পকিছু সুনাম থাকলেও কলেরা-বসন্তের চিকিৎসার জন্য খুব সুনাম ছিল। কলেরা-বসন্তের রোগী তার হাতে গেলে বেঁচে যাবেই-এরকম ধারণা ঐ গ্রামের ও আশেপাশের গ্রামের লোকদের ছিল। হিন্দুপাড়ার লোকেরা তাকে দেবতার মত সম্মান করত। হিন্দুদের সঙ্গে তার বেশি চলাফেরা। হিন্দুদের অনেক কুমারী যুবতী তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। সে মুসলমান বলে তারা মনের বাসনা প্রকাশ করতে পারে না। নওশের ডিসপেনসারী বন্ধ হবার পর হিন্দু পাড়ায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে প্রতিদিন অনেক রাতে বাসায় ফিরত। তার আসল বাড়ি রাজরাড়ী। রাজশাহীর শহরতলী মহেশবাথানে তার ডিসপেন্সারী। বিয়ের পর সে স্ত্রীকে নিয়ে এখানে বাসা ভাড়া করে থাকে।
নওশেরের স্ত্রী মায়মুনা অত্যন্ত ধার্মিক। কিন্তু দেখতে তেমন ভাল না। লম্বা, রোগা ও গায়ের রং কাল। তার আব্বা অনেক টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র যৌতুক দিয়ে নওশেরকে জামাই করেছেন। তারপরেও তিনি এই ডিসপেনসারী করার খরচ দিয়েছেন। তবু মায়মুনা স্বামীকে নিজের করে পায়নি। সে ভাবে তার স্বামী দেখতে খুব সুন্দর আর সে দেখতে খারাপ তাই স্বামী তাকে পছন্দ করে না। মায়মুনা স্বামী কি জিসিন এবং স্বামীর মন জয় করার মতো শিক্ষা, কুরআন-হাদিস এবং বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়ে অর্জন করেছে। সেই শিক্ষা অর্জনের ফলে স্বামীকে যেমন মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে, তেমনি তার সেবাযত্নও করে। স্বামী যে সময় মত ঘরে আসে না, খাওয়া-দাওয়া করে না, গভীর রাতে নেশা করে বাসায় ফিরে, সেজন্যে কোনদিন তার কাছে এতটুকু কৈফিয়ত চায় না, এতটুকু রাগও দেখায় না। বরং নেশাগ্রস্ত স্বামীর সেবাযত্ন করে। স্বামী যেদিন বাসায় খায় না, সেদিন মায়মুনাও খায় না। সে যতক্ষণ না ফিরে ততক্ষণ কুরআন পড়ে, হাদিস পড়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় বই ও ভাল গল্প উপন্যাস পড়ে। স্বামী ফেরার পর তার জামা-জুতো খুলে দিয়ে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর তাহাজ্জুদের নামায পড়ে আল্লাহপাকের দরবারে দুহাত তুলে দরবিগলিত চক্ষে দোয়া করে-হে গফুরুর রহিম, তুমি এই ভূমণ্ডল ও আকাশমণ্ডলীর একমাত্র প্রভু। এই দুই জাহানের মধ্যে সমক্ষক কেউ নেই। তুমি সর্বশক্তিমান ও সর্বজ্ঞ। তুমিই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা ও পালন কর্তা। তোমার ইচ্ছা ব্যতিরেকে কারো এতটুকু কিছু করার অধিকার নেই। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তোমার কোন কাজে এতটুকু বাধা দেয়ার কারো ক্ষমতা নেই। তুমি তোমার সৃষ্ট জীবের মনের কামনা-বাসনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকেফহাল। হাদিসে পড়েছি- তোমার পেয়ারা নবী (দঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর বান্দার মনের নেক মকসুদ পূরন করেন। তোমার কালাম পাকে পড়েছি, তুমি যাকে ইচ্ছা কর। তাকে হেদায়েৎ দান কর। তোমার ইচ্ছা ব্যতীত কেউ হেদায়েৎ প্রাপ্ত হয় না। আমি তোমার এক গোনাহগার বান্দী এবং তোমার পেয়ারা হাবিবের (দঃ) নগণ্য উম্মত। আমি তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি, আমার স্বামীকে হেদায়েৎ দান করে তোমার ও তোমার হাবিবে পাকের (দঃ) প্রদর্শিত পথে চালিত কর। আমি তোমার কাছে ঐশ্বর্যের সুখভোগ চাই না। চাই শুধু আমার স্বামীর হেদায়েৎ। হাদিসে আরো পড়েছি, কোন মুসলমান যদি অন্য মুসলমানের জন্য দোয়া করে, তা হলে তুমি তা কবুল করে থাক। আমি কুরআন-হাদিসের উপর পূর্ণ একিন রেখে ফরিয়াদ করছি, আমার দোয়া কবুল করে আমাকে ধন্য কর।