জুলেখা চলে যাওয়ার পর সাজেদা এতক্ষণ দুরুদুরু বুকে নাদিমের কথা চিন্তা করতে করতে আমেনার সঙ্গে কথা বলছিল। জুলেখা ঘরে ঢুকলে তার দিকে তাকাতে গিয়ে দরজায় একজন সুদর্শন যুবককে দেখে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ভাবল, নিশ্চয় নাদিম।
নাদিম ভাবীর সঙ্গে এসে সাজেদাকে দেখে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাজেদা মাথা নিচু করে নিলে তাকে ভাল করে দেখে খুব অবাক হল। সত্যি মেয়েটা অত্যন্ত সুন্দরী।
জুলেখা দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে নাদিমকে বলল, একেই মুরব্বিরা তোমার জন্য নির্বাচিত করেছেন। তারপর একটা হাত ধরে ভিতরে এনে বলল, কি ব্যাপার, দুজনেই যে চুপচাপ? ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি। তোমরা দুজন দুজনকে ভাল করে দেখ, কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস কর। আমি তোমাদের জন্যে নাশতা নিয়ে আসি। তারপর আমেনাকে সাথে করে বেরিয়ে গেল।
সাজেদাকে দেখে নাদিমের একটা হাদিস মনে পড়ল, আল্লাহ পাকের রসুল (দঃ) বলেছেন, যার বেশি ধন সম্পত্তি থাকে, সে ধনের অহঙ্কার করে। যে খুব শক্তিশালী, সে শক্তির অহংকার করে। যার রূপ থাকে, সে রূপের অহংকার করে। এই মেয়ে খুব রূপসী, এরও নিশ্চয় রূপের অহংকার আছে। এই কথা ভেবে সে এতক্ষণ শংকিত মনে চিন্তা করছিল, এর যদি রূপের অহংকার থাকে তা হলে একে বিয়ে করে আমি কি সুখী হতে পারব? না আমি ওকে সুখী করতে পারব?
ভাবি ও আমেনা চলে যাওয়ার পর নাদিম সালাম দিয়ে নাম জিজ্ঞেস করল।
সাজেদা একবার মাথা তুলে নাদিমের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নিয়ে সালামের উত্তর দিয়ে নাম বলল।
নামের অর্থ জানেন?
না, আপনি বলে দিন।
ধার্মিক। ধার্মিক কাকে বলে জানেন?
জানব না কেন? যে ধর্মের আইন মেনে চলে তাকে ধার্মিক বলে।
আপনি কি ধর্মের আইন মেনে চলেন?
যতটা সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করি। আপনার নামের অর্থটা বলুন।
আমার নাম জানেন দেখছি। পুরো নাম জানেন?
না।
আসেফ নাদিম।
এবার অর্থটা বলুন।
যোগ্য সঙ্গী।
দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।
ঠিক আছে, বসা লাগবে না। আরো দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করব। কিছু মনে করবেন না তো?
মনে করার কি আছে। করুন, কি জিজ্ঞেস করবেন।
মাথায় কাপড় দেননি কেন? মেয়েদের মাথার চুল গায়ের মোহররাম লোককে দেখান হারাম এটা কি জানেন?
সাজেদা ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বলল, মেয়েদের মাথায় কাপড় দিতে হয় জানতাম, কিন্তু যা বললেন তা জানতাম না।
নাদিম বলল, মেয়েদের শুধু মাথায় কাপড় দিলেই আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর হুকুম মানা হয় না। এমনভাবে মাথা ঢাকতে হবে যেন চুল পরপুরুষের নজরে না পড়ে। সেই জন্যেই উত্তম পন্থা হল, আলাদা রুমাল দিয়ে চুলসহ পুরো মাথা বেঁধে রাখা। যাক, নিশ্চয় লেখাপড়া করেছেন?
এস.এস.সি. পাশ করেছি।
বেহেশতী জেওর পড়েছেন?
না।
বেহেশতী জেওর প্রত্যেক সাবালক নর-নারীর পড়া অবশ্য কর্তব্য। পড়ে দেখবেন, আমার কথা কতটা সত্য।
এতক্ষণ কথা বলতে বলতে সাজেদার সাহস বেড়ে গেছে। বলল, এবার আমি দুএকটা প্রশ্ন করতে পারি?
নিশ্চয়।
কুরআন শরীফে প্রত্যেক সূরার আগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লেখা আছে। কিন্তু একটা সূরার আগে তা নেই, সেই সূরাটার নাম কি? আর সেই সূরাটা কত পারায়? (এটা সে যার কাছে কুরআন পড়া শিখেছে তার কাছে জেনেছিল)।
দশ পারায়, সূরা তওবা।
এমন সময় জুলেখা নাশতা নিয়ে এসে নাদিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আরে তুমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছ? বস বস, নাশতা খাবে?
নাদিম বলল, না ভাবি, আমি এখন কিছু খাব না। তুমি মেহমানকে নাশতা করাও, আমি যাই বলে চলে যেতে উদ্যত হল।
জুলেখা বলল, দাঁড়াও, যাওয়ার আগে বলে যাও কেমন দেখলে?
পরে বলব, বলে নাদিম চলে গেল।
জুলেখা সাজেদাকে নাশতা খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, নাদিম ভাইকে কেমন মনে হল?
সাজেদা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ভাল।
ঐদিন রাতেই সাজেদার সঙ্গে নাদিমের বিয়ে হয়ে গেল।
২. নাদিমের খুব বই পড়ার নেশা
নাদিমের খুব বই পড়ার নেশা। ছোটবেলা থেকে স্কুলের পাঠ্যবই পড়ার পর ধর্মীয় বই ও উপন্যাস পড়ে আসছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় আইনের অনুশীলনও করে আসছে। সে দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়ার সময় নজীবর রহমানের আনোয়ারা পড়ে। তৃতীয় শ্রেণীতে শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে তিন দিন কেঁদে কেঁদে ভাত খায়নি।
তার মা আফ্রিদা জানতে পেরে অতটুকু ছেলের অনুভূতির কথা চিন্তা করে খুব অবাক হয়ে ছেলেকে বুঝিয়ে বললেন, দেবদাসের কাহিনী সত্য নয়। ওটা তো গল্প। লেখকরা কল্পনা করে গল্প-উপন্যাস লিখে। তারপর থেকে ছেলে স্কুলের বই ছাড়া অন্য বই যাতে না পড়ে সেদিকে খুব লক্ষ্য রাখল। কিন্তু কতক্ষণ আর লক্ষ্য রাখবে? সংসারের কাজের ঝামেলায় তা সম্ভব হয় না। নাদিম শব্দ করে পড়তে পারে না। খুব তেজী ছেলে। যে কোন পড়া দুএকবার পড়লেই হয়ে যায়। সেই জন্যে সে সকাল ও সন্ধ্যেয় বড়জোর এক ঘণ্টা করে দুঘণ্টা পড়ে। তাও মা এবং বাপ-চাচাদের ভয়ে। নচেৎ তার পড়া কিন্তু সন্ধ্যের পর এক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। সকালে শুধু অঙ্ক করে। যখন ক্রমশঃ উপরের ক্লাসে উঠতে লাগল তখন তার মাও বাপ চাচারা বেশিক্ষণ পড়ার জন্য তাকে চাপ দিতে লাগল। নাদিম সেই সুযোগে স্কুলের পাঠ্য বইয়ের পড়া তৈরি করে সেই বইয়ের উপর গল্পের বই রেখে পড়ত। মাঝে মাঝে আফ্রিদা ছেলের অপকীর্তি ধরে ফেলে শাসন করত। কিন্তু ছেলের গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য আউট বই পড়ার অভ্যাস ছাড়তে পারল না। এ ব্যাপারে বাপ-চাচারা তাকে অনেক শাসন করেও কোন লাভ হয়নি। নাদিম যদি আউট বই না পড়ে শুধু স্কুলের পাঠ্যবই পড়ত, তা হলে প্রতি বছর স্ট্যান্ড করত। তবু তার রোল নাম্বার চার-পাঁচের মধ্যে উঠানামা করেছে। স্কুলেও সে ব্যাগে করে পাঠ্য বইয়ের সঙ্গে আউট বই নিয়ে যেত। ক্লাসের ফার্স্ট বয় এর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। ছেলেটার নাম সুভাষ। তাদের গ্রামেরই ছেলে। তার পাশে ফাস্ট বেঞ্চে বসত। তক্তপোসের উপর স্যারের টেবিল-চেয়ার। নাদিম টেবিলের আড়ালে বসে হাই বেঞ্চের নিচে দুই ঊরুর উপর আউট বই রেখে পড়ত। সুভাষ তাকে অনেকবার বলেছে, তুই এখন এত আউট বই পড়িস না। পাঠ্য বই পড়লে অনেক ভাল রেজাল্ট করতে পারতিস। আমার চেয়ে তোর মাথা অনেক ভাল। নাদিম হেসে বলে, আমি বেশি ভাল রেজাল্ট করতে চাই না। পাস করা নিয়ে কথা। তা তো প্রত্যেক বছর করছি। একবার দশম শ্রেণীতে ক্লাস চলাকালে ইংলিশের স্যার তাকে একটা প্রশ্ন করলেন। নাদিম তখন কোলের উপর একটা উপন্যাস রেখে পড়ছিল। স্যার যে তাকে প্রশ্ন করেছেন বুঝতে পারল না। সুভাষ তাকে কুনুইয়ের গুতো মেরে ফিসফিস করে বলল, এই নাদিম, স্যার তোকে প্রশ্ন করেছেন। নাদিম তাড়াতাড়ি করে বইটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার প্রশ্নটা আর একবার বলুন।