কয়েকদিন পর একদিন রহিম সব ভাই ও ভাইদের বৌকে নিয়ে বসল। সেদিন স্কুল বন্ধ থাকায় নাদিম ঘরে ছিল। তাকেও ডাকা হল। সকলে আসার পর রহিম বলল, আল্লাহপাকের অসীম রহমতে আমরা বহুদিন সবাই মিলেমিশে এক সংসারে কাটালাম। এখন আমাদের প্রত্যেকের সংসার বড় হয়েছে। লোক-সংখ্যাও বেড়েছে। এতবড় সংসার সুষ্ঠ ভাবে চালানো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের বিয়ে-শাদি দিতে হবে। নুতন বাড়িঘর করাও দরকার। তা ছাড়া একদিন না একদিন তো আমাদেরকে আলাদা হতেই হবে। আব্বা সে কথা জানতেন। তাই তিনি নিজে সব জায়গা জমি আগান-বাগান, পুকুর-ডোবা বাড়ি-ঘর প্রত্যেকের নামে নামে ভাগ বাটোয়ারা করে খাতায় লিখে রেখে গেছে। আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন, সে কথা হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যাতে আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য না হয় সে ব্যবস্থা করে রেখে গেছেন। এমন কি বোনদের অংশও লিখে রেখেছেন। সেই খাতাটা সিন্দুকে ছিল। নাদিমের মা পেয়ে সেটা এতদিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছে, আমি সে কথা জানতাম না। গতকাল আমার হাতে দিয়ে পড়তে বলে বলল, আমি এতদিন এটা গোপন রেখেছিলাম। কারন তখন সংসার ভাগাভাগি করতে আমার মন চায় নি। এখন আর এত বড় সংসার একসঙ্গে থাকলে ঝগড়াঝাটি সৃষ্টি হতে পারে। তাই এবার সবাইকে যে যার অংশ বুঝিয়ে দিয়ে আলাদা করে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আমিও তাই চিন্তা করে সেই ব্যবস্থা করার জন্য তোমাদেরকে নিয়ে বসেছি। তারপর সে খাতাটা সুলতানের হাতে দিয়ে বলল, তোমরা একে একে সবাই পড়ে দেখ।
খাতাটা সবাই পড়ার পর রহিম বলল, আব্বা যেভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন, তাতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?
সব ভাইয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, না। ইলিয়াস ঘরে ছিল না। সেও এক সময় সেখানে এসেছে। চাচারা পড়ার পর নাদিম পড়ে ইলিয়াসের হাতে দিল। সেও পড়ল।
রহিম নাদিম ও ইলিয়াসকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের কিছু বলার থাকলে বল।
ইলিয়াস শুধু না বলল।
নাদিম বলল, বিষয়-সম্পত্তি দাদাজীর। আপনারা সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আপনারা সবাই যখন একমত তখন আমরাও একমত। আমার মনে হয়, দাদাজী যেভাবে বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন, আপনারা করলে এত নিখুঁতভাবে করতে পারতেন না।
রহিম বলল, সবার মতামত শুনে খুশি হলাম। কারণ আমাদের মধ্যে কেউ আপত্তি করলে ভাগ-বাটোয়ারা করতে বাইরের পাঁচজনকে ডাকতে হত। এখন আমি আব্বার লেখামতো তোমাদেরকে সবকিছু দিয়ে আলাদা করে দেব। এবার তোমরা তোমাদের সংসারপত্র গুছিয়ে চালাবার চেষ্টা কর। আর একটা কথা, এই ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যাপারে আমি অন্য কাউকে ডাকতে চাই না। আমরা নিজেরা করে নেব। এতে তোমাদের কোনো আপত্তি নেই তো?
সবাই বলল, না নেই। শুধু কুদ্দুস চুপ করে রইল।
রহিম ফাহমিদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ছোট বৌ, তোমার হিসাবের খাতাটা নিয়ে এস। আর সেই সাথে সিন্দুকে যা টাকা আছে নিয়ে এস।
সিন্দুকটা বরাবর আব্দুস সোবহান চৌধুরীর রুমে ছিল উনি ও উনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও ঐ রুমে আছে। ফাহমিদা উঠে গিয়ে হিসাবের খাতা ও সব টাকা পয়সা নিয়ে এসে বড় ভাসুরের সামনে রেখে দিল।
রহিম হিসাবের খাতায় চোখ বুলিয়ে ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করল, জমা-খরচের পর যে পরিমাণ টাকা লেখা আছে সব টাকা এখানে আছে?
ফাহমিদা বলল, জি আছে।
রহিম বলল, টাকাগুলো চার ভাগ কর।
ফাহমিদা বড় ভাসুরের কথামত চার ভাগ করল।
রহিম প্রত্যেক ভাইয়ের হাতে এক ভাগ টাকা তুলে দেয়ার সময় বলল, এখন এগুলো নাও, পরে সবকিছু ভাগ করার ব্যবস্থা করছি।
কুদ্দুসকে টাকা দিতে গেলে সে টাকা না নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, টাকার ভাগ তো। দিচ্ছ, তারপর উঠে এসে বড় ভাবির দুপা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, এর ভাগ দেবে না? বড় ভাবি আমাদের মায়েরমতো ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে। মায়ের ভাগ না দিলে আমি শুধু টাকা কেন সম্পত্তিরও ভাগ নেব না। কথা শেষ করে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার বলল, আমাদের আব্বার কথা মনে নেই। তুমিও আমাদেরকে আব্বার মতো শাসন করে, স্নেহ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে, লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছ; তোমাকেও ভাগে পেতে চাই।
কুদ্দুসের কথা শুনে সবার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। রহিম হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, অত অবুঝের মতো কথা বলিস না ভাই। আমরা তো তোদেরই আছি এবং যতদিন বাঁচব ততদিন থাকব। এত বড় সংসার একসাথে থাকায় কত রকমের অসুবিধে হচ্ছে। এরকম যে হবে-আব্বা জানতেন। তাই তিনি সেইরকম ব্যবস্থা করে গেছেন। এবার নিজেদের সংসার নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে উন্নতির চেষ্টা কর। আমরা তো তোদের কাছেই রয়েছি। তোদের সুবিধে-অসুবিধে হলে। আমরাই দেখব। নে টাকাগুলো নে।
কুদ্দুস বলল, না, আমার টাকার দরকার নেই; আমি তোমার সঙ্গে থাকব আলাদা হব না।
আফ্রিদা বলল, কুদ্দুস, তুই বড় ভাইয়ের কথা না শুনে বেয়াদবি করছিস। আমি কি তোকে সেইভাবে মানুষ করেছি? টাকা নে বলছি। কুদ্দুস চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বড় ভাইয়ের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে আফ্রিদার পায়ের কাছে রেখে বলল, তোমাদেরকে আমি আব্বা-আম্মা মনে করি। আমি মরে যাওয়ার পর ফাহমিদাকে আলাদা করে দিও। তারপর সে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল।