পরের দিন দুপুরে সাজেদা খিড়কী পুকুরে গোসল করতে গিয়ে দেখল, মেজ ও সেজ শাশুড়ী গোসল করে ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি-সব কথা বলাবলি করছে। সাজেদাকে দেখে তারা চুপ করে গেল।
এই পুকুরটা বাড়ির পিছন দিকে। পুরুষদের সেদিকে যাওয়া নিষেধ। যদি কোনো কারণে যেতে হয়, তা হলে সেদিকে মেয়েরা কেউ আছে কিনা জেনে তারপর যায়। তবু ঘাটের তিন দিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা।
সাজেদা ঘাটে আসার পর মেজ ও সেজ চলে গেল। সে হাতে-পায়ে সাবান মাখছিল এমন সময় ফাহমিদা গোসল করতে এল। প্রায় সময় তারা দুজনে একসঙ্গে গোসল করে।
সাজেদা তাকে জিজ্ঞেস করল, ছোট মা, কি ব্যাপার বল তো, মেজ মা ও সেজ মা কি-সব কথা বলাবলি করছিল; আমাকে দেখে আলাপ বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
ফাহমিদা অনুমান করে বলল, গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে হয়ত বলাবলি করছিল।
আমার শ্বশুর কি শুনেছে?
তা বলতে পারব না। তুমি নাদিমকে কিছু বলেছ নাকি?
না বলিনি। ভাবছি আজ বলব।
তারপর তারা আর কোনো কথা না বলে দুজন দুজনের গায়ে সাবান মাখিয়ে গোসল করে ফিরে এল।
রাতে নাদিম ঘরে এলে সাজেদা ঘটনাটা তাকে জানাল।
নাদিম শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দেখছি। আমাকেই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই রাতেই খাওয়া-দাওয়ার পর সব চাচা-চাচিরা চলে যেতে নাদিম আব্বা আম্মাকে বলল, একটা কথা তোমাদেরকে বলতে চাই। কথাটা বললে বেয়াদবি হবে, তাই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
রহিম কিছু না বলে চুপ করে রইল।
তাই দেখে আফ্রিদা বলল, কি বলবি বল।
এবার আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন? তোকে কি কেউ এ কথা বলতে বলেছে?
না আম্মা, আমাকে কেউ বলেনি। আমি মনে করি, চাচা-চাচিদের সাথে আমাদের কোনো বিষয়ে গোলমাল হওয়ার আগে আলাদা হয়ে গেলে সবার ইজ্জত রক্ষা হবে। তা ছাড়া আজ হোক কাল হোক, একদিন না একদিন তো আলাদা হতেই হবে। চিরকাল কি কেউ এক সংসারে থাকে?
আজ এশার নামাযের পর রহিম যখন মসজিদ থেকে বেরোচ্ছিল তখন সুলতান তাকে গতকালের ঘটনাটা বলে। এখন নাদিম যা বলল ঠিক সেই কথাই বলেছে। রহিম তাকে তখন বলেছে, ঠিক আছে, একদিন সব ভাই বসে সে ব্যাপারে আলাপ করে যা করার করা যাবে।
এখন নাদিমের কথা শুনে রহিম তাকেও ঐ একই কথা বলল।
নাদিম বলল, তাই করেন আব্বা। তারপর সে নিজের রুমে চলে গেল।
ছেলের ও স্বামীর কথা শুনে আফ্রিদা ভাবল, আমি মমতাজকে মাঝে মাঝে এটা ওটা দিই বলে কি নাদিম জানতে পেরে ঐ কথা বলল? আর নাদিমের আব্বাও কি এ ব্যাপারে শুনে এই কথা বলল? না দেবররা তাদেরকে আলাদা হওয়ার কথা বলেছে? স্বামীকে চুপ করে ভাবতে দেখে বলল, কি ভাবছ, আমার মনে হয় নাদিম টিক কথাই বলেছে।
রহিম বলল, আমার কাছেও তাই মনে হল বলে তো ঐ কথা বললাম।
নাদিম নিজের রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, আম্মা কি আমার কথা শুনে মনে কষ্ট পেল? মনে মনে বলল, আম্মা আমাকে মাফ করে দিও। এছাড়া তোমার ইজ্জত বাঁচাবার অন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছ থেকে ফিরে এসে স্বামীকে চুপ করে শুয়ে থাকতে দেখে সাজেদা মনে করল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবু ঘাড় তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, জেগে আছে। বলল, কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, ভাবছি।
কি ভাবছ?
সবাই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা আব্বা-আম্মাকে বললাম। কি, ঠিক করিনি?
হ্যাঁ, ঠিক করেছ। কিন্তু…বলে সাজেদা থেমে গেল।
কি হল, কিন্তু বলে থেমে গেলে কেন?
আমার মনে হয় আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আম্মা আরও বেশি মমতাজকে ঐ সব দিবে।
তাতে কি হয়েছে? তখন তো আর কারো কিছু বলার থাকবে না।
তা থাকবে না, তবে সংসারের কোনোদিন উন্নতি হবে না এই কথা শুনে নাদিম খুব রেগে গেল। রাগ সামলাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
সাজেদা তা বুঝতে পেরে চিন্তা করল, কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ভয়ে ভয়ে বলল, কথাটা বলে বোধ হয়ে আমি ভুল করেছি, সে জন্যে মাফ চাইছি। নাদিম ততক্ষণে রাগ সামলে সাজেদার কথায় খুশি হয়ে বলল, ভুল করলেও কথাটা ঠিক বলেছ। তবে
এরকম কথা আর কোনোদিন মাথার মধ্যে এনো না। সংসারের উন্নতি-অবনতি মানুষের ভুল কাজের দ্বারা হলেও ভাগ্যের উপর তার চাবিকাঠি। আমাদের ভাগ্যে যদি উন্নতি থাকে, তা হলে যেমন করে হোক তা হবেই। আর যদি তা না থাকে, তা হলে আম্মাকে অসিলা করে আমাদের দুঃখ-কষ্ট হবে। সব কিছু আল্লাহপাকের ইশারা। বাবা মার দোষ কোনোদিন ধরবে না। যদি তারা দোষ করে থাকে, মনে করবে এটাই ভাগ্য। বাবা-মার দোষ ধরা কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিষেধ। যদি তারা ইসলামের পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে তাদেরকে আলাদা করে দিয়ে তাদের ভরণপোষণ করে যেতে হবে। কোনো ব্যাপারেই তাদের মনে এতটুকু কষ্ট দেয়া চলবে না। জেনে রেখো, পিতামাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত। তাদেরকে সন্তুষ্ট রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় করতে পারলে আল্লাহপাক বেহেশতের ওয়াদা করেছেন। তোমাকে আবার বলছি, আব্বা-আম্মার দোষ যেমন কোনোদিন ধরবে না, তেমনি তা অন্য কাউকেও বলবে না। তারপর সে চুপ করে গেল।
সাজেদা বুঝতে পারল, এবার নাদিম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সেও ঘুমিয়ে পড়ল।