সাজেদা শুনে কোনো কথা বলল না। চিন্তা করল, এবার যখন অন্যের চোখে পড়েছে তখন নাদিমকে জানান উচিত। রাতে ঘুমাবার সময় সাজেদা স্বামীকে বলল, তুমি যদি সাহস দাও, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।
নাদিম বলল, কি এমন কথা যার জন্য সাহস দিতে বলছ? বল কি বলবে?
তার আগে তুমি বল, কথাটা শুনে রেগে যাবে না।
নাদিম ভাবল, নিশ্চয় সাংসারিক ব্যাপারে কারো সঙ্গে কিছু হয়েছে। বলল, রাগের কথা বললে রেগে যাওয়াটা কি অন্যায় হবে?
না, তা কেন হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ করব না, এবার বল।
আম্মা যে গোপনে মমতাজকে প্রায়ই সবকিছু দিয়ে পাঠান, তা আমি অনেক আগে জেনেছি। কিন্তু আজ যখন চাকর জামালকে দিয়ে চাল পাঠাচ্ছিল তখন ছোট মা দেখে ফেলেছে।
নাদিম কথাটা শুনে খুব অবাক হল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আম্মা এরকম করবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাজেদা মনে করল, হয় সে খুব রেগে গেছে, নচেৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। কারণ সাজেদা জানে, নাদিম রেগে গেলে চুপ করে রাগটা হজম করে। আর সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই কথা ভেবে স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, কি হল, কিছু বলছ না যে?
নাদিম বলল, মমতাজকে যতটা সাহায্য করার আমরা করি। তারপরও আম্মা এ রকম করবে তা কল্পনাও করতে পারছি না। ছোটমা কাউকে বলবে না ঠিক। কিন্তু পরে অন্যেরা জানতে পারলে আম্মার মান-সম্মান এতটুকু থাকবে না। আম্মা মমতাজকে ভীষণ ভালবাসে। তাই তার অভাব দেখে সহ্য করতে না পেরে স্নেহের দুর্বলতার কারণে এই কাজ করছে। কথাটা বলে তুমি খুব ভালো করেছ। চিন্তা করে দেখি, কি করা যায়।
দুদিন পর নাদিম ছোটমাকে ঐ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হল তারপর আব্বা ও চাচাদেরকে মমতাজকে এনে চিকিৎসা করানোর কথা বলল।
সবাই তার কথায় সায় দিল।
নাদিম একদিন সুলতানগঞ্জ গিয়ে মমতাজকে নিয়ে এসে অলোক ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে লাগল। প্রায় ছমাস চিকিৎসা করেও সম্পূর্ণ ভালো হল না। যতদিন ওষুধ খায় ততদিন একটু ভালো থাকে। ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলে যেইকে সেই। শেষে এক পীর সাহেবের তদবীর করাতে কিছুটা উন্নতি হল। কিন্তু পুরোপুরি ভালো হল না। এবার আসাদ রাজশাহী থেকে এসে মমতাজকে নিয়ে গেল।
মমতাজ চলে যাওয়ার মাস দুই পর আফ্রিদা গোপনে তাকে চাল পাঠাবার সময় মেজজা আয়মন দেখে ফেলল। দেখার পর বড় জাকে বলল, মমতাজকে যা দেয়ার তার বাপ চাচারা দেয়, তুমি আবার সবাইকে গোপন করে দাও কেন? কারটা দাও? এক সংসারের জিনিস দাও কি করে? এরকমভাবে আরও কত কি কতদিন ধরে দিচ্ছ তা আল্লাহই জানে। এই সব বলে ঝগড়া করতে চাইল।
কিন্তু আফ্রিদা তার একটা কথারও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
আয়মন কাউচাতে কাউচাতে এক সময় চুপ করে গেল। কিন্তু সব জায়েরা জেনে গেল।
রাতে আয়মন স্বামীকে কথাটা জানিয়ে বলল, এবার আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া দরকার। এক সংসারে থাকলে বড় বুবু মমতাজকে সব কিছু দিয়ে দিয়ে সংসারের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
সুলতান বলল, অত কথা বলছ কেন? যা বলছি শুন আমিও কিছুদিন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। দেখি, অন্য ভাইদের সঙ্গে কথা বলে, তারা কি বলে। আমি একা প্রথমে বলে দোষী হতে যাব কেন?
সুলতানের এই রকম ভাবার কারণ আছে। তার বড় ছেলে ইলিয়াস এম. এ. পাস করে একটা ভালো চাকরি করছে। সংসার এক জায়গায় আছে বলে বেতনের টাকা ছোট মায়ের হাতে দিয়ে দিতে হয়। ছেলের টাকা পাচ্ছে না। তাই সে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে।
আবিদা যখন স্বামীকে ঘটনাটা জানাল তখন আজিজ স্ত্রীকে বলল, এ ব্যাপারে তুমি বড় ভাবিকে কিছু বলল না। চুপ করে দেখ, মেজ ভাই ও মেজ ভাবী কি করে।
কুদ্দুস স্ত্রীর কাছে শুনে সেজ ভাই আজিজের মতো বলল, মমতাজের খুব অভাব, তার উপর সে চিররুগ্ন। তাই হয়ত বড় ভাবি তাকে এটা-ওটা দিয়ে সাহায্য করে। কই, অন্য কোনো মেয়েকে তো দেয় না। খবরদার, এ নিয়ে তুমি, বড় ভাবিকে কিছু বলা তো দূরে থাক, মেজভাবি ও সেজ ভাবির সঙ্গে কখনও আলোচনাও করবে না। বড় ভাবি মায়ের মতো আমাদেরকে মানুষ করেছে। তার কোনোদিন কোনো দোষ ধরবে না।
ফাহমিদা এ বাড়িতে যখন বৌ হয়ে আসে তখন আফ্রিদা তাকে সবকিছু বুঝিয়ে পড়িয়ে শিখিয়েছে। কাজে-কামে দোষ করলে অন্য জায়েরা ট্যাক ট্যাক করলেও বড় জা কোনদিন কিছু বলেনি। বরং অন্য জাদের বলেছে, নতুন বৌ, তার উপর কতই বা বয়স, এরকম একটু-আধটু দোষ হবেই। তোরা যখন নতুন বৌ হয়ে এসেছিলি তখন তো আমি তোদেরকে কিছু বলিনি। তারপর ফাহমিদাকে কাঁদতে দেখে আপন বোনের মতো তাকে প্রবোধ দিয়েছে আর যাতে ঐরকম দোষ না হয়, সে জন্যে কত বুঝিয়েছে। বড় জা যে দেবরদের গু-মুত নেড়ে মানুষ করেছে তা ফাহমিদা জানে। আর দেবররা যে বড় ভাবিকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে তাও জানে। এখন স্বামীর কথা শুনে বলল, বড় বুবু যে অনেকদিন থেকে মমতাজকে সবকিছু গোপনে দেয়, তা আমি অনেক আগে থেকে জানি। কই, কোনোদিন কি তোমাকে কিছু বলেছি? বড় বুবু কাকে কি দিল না দিল ওসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। আজ মেজ বুবু দেখে ফেলে তাকে অনেক কথা। শুনিয়েছে।
কুদ্দুস বলল, সে বলুক গে তাতে আমাদের কি? বড় অবিকে যখন মায়েরমতো জানি তখন সে যা খুশি করুন, আমি কোনো দিন কিছুকলবনা। আর তুমিও বলবেনা।