এইসব শুনে আসাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কোনো কথা বলতে পারল না।
আসাদের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ঐ লোক বলল, মনে হচ্ছে আপনার বাবা আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি কাগজপত্র দেখুন, তারপর আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলুন। উনি বোধ হয় সবকিছু জানেন।
আসাদ দলিল পড়ে ফেরত দেয়ার সময় বলল, আপনার অনুমান সত্য। আব্বা আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি এখন যান, আমি আম্মার সঙ্গে কথা বলে পরে আপনাকে জানাব।
লোকটি চলে যাওয়ার পর আসাদ মাকে সব কথা জানাল।
আনোয়ারা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর আব্বা যখন দোতলা বাড়ি করতে চাইল তখন অত টাকা কোথায় পাবে জিজ্ঞেস করতে জমি সাফকওলা রেখে টাকা নেয়ার কথা বলেছিল। তবে কতটা জমি, কত বছরের জন্য, কত টাকা নিয়েছিল তা আমাকে বলেনি।
আসাদ বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু আম্মা, আব্বা মারা যাওয়ার পরও আমাকে জানাওনি কেন? এতদিনে হয়ত কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। এখন কি হবে? কোল কাদালের বিঘে দেড়েক জমি ছাড়া সব জমি আব্বা সাফকওলা করে গেছে। এখন আমি কি করে এত টাকা জোগাড় করব?
আনোয়ারা ছেলের হতাশা দেখে বলল, এত ভেঙে পড়ছিস কেন? ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। তুই একবার জাকিরের কাছে যা। তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে টাকাটা জোগাড় করে দিতে বলবি।
আসাদ বলল, সে কোথা থেকে দেবে? চাকরি করে যা পায় তাতে বাসা ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এতদিনে হয়ত ছেলেমেয়ে হয়ে সংসার আরও বড় হয়েছে।
আনোয়ারা জাকির ছোট বলে তাকে বেশি ভালবাসত। প্রথম যখন তার কীর্তিকলাপ শুনে তখন মনে খুব আঘাত পেয়ে খোঁজ খবর করেনি। তবে মাঝে মাঝে তার কথা মনে পড়লে চোখের পানিতে বুক ভাসায়। এখন আবার তার কথা আমাদের মুখে শুনে চোখের পানি রাখতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, জাকির যে এরকম হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তুই আমাকে নিয়ে চল, অনেক বছর তাকে দেখিনি।
আসাদ ছোট ভাইকে অত্যন্ত স্নেহ করত। আজও করে। যদিও সে বড় ভাইয়ের ও মায়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখেনি। মায়ের কথা শুনে বলল, জাকিরের বৌ খুব বড়লোকের মেয়ে, তোমাকে সে সহ্য করতে পারবে না। জাকির হয়ত কিছু বলবে না, কিন্তু তার বৌ আমাদেরকে দেখলে খুব অসন্তুষ্ট হবে। তার উপর যখন জানবে আমরা টাকার জন্য এসেছি তখন আমাদেরকে কি বলবে জানি না, তবে জাকিরের সঙ্গে তার খুব মনোমালিন্য হবে। তার চেয়ে আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছে তাই হোক।
আনোয়ারা দৃঢ়স্বরে বলল, বৌ যাই করুক না কেন আমি যাবই। আর টাকা দেবে নাই বা কেন? সে কি বাপের সন্তান নয়? আমি কি তাকে পেটে ধরিনি? তুই যদি নিয়ে যাস, তা হলে আমি খালেককে নিয়ে যাব।
আসাদ বলল, সেখানে গেলে তুমি দুঃখ পাবে। তাই নিয়ে যেতে চাইনি। একান্তই যখন যেতে চাচ্ছ তখন আমিই তোমাকে নিয়ে যাব। খালেককে বলতে হবে না।
পরের দিন আসাদ মাকে নিয়ে ঢাকায় জাকিরের বাসায় গেল। কিন্তু সেখানে তাকে পেল না। যারা সেই বাসায় আছে তারা তার কথা জানে না বলে বলল। আসাদ জাকিরের অফিসের ঠিকানা জানত। মাকে একটা হোটেলে রেখে অফিসে গিয়ে শুনল, সে আজ থেকে এক বছর আগে চাকরি নিয়ে ফ্যামিলিসহ আমেরিকা চলে গেছে।
হোটেলে ফিরে এসে মাকে জাকিরের আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা বলল।
আনোয়ারা বলল,আমেরিকার ঠিকানা জেনেছিস?
আসাদ বলল, জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা জানে না বলল।
আনোয়ারা আবার বলল, ওর শ্বশুরের ঠিকানা জানিস না?
আসাদ বলল, না।
আনোয়ারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সব কিছু আল্লাহপাকের ইচ্ছা। একদিন হোটেলে থেকে আসাদ মাকে নিয়ে বাড়ি ফিলে এল। তারপর আসাদ মহাজনের বাড়িতে গিয়ে তাকে অপারগতার কথা জানিয়ে এল। এরপর থেকে আসাদের সংসারে চরম দুর্দিন নেমে এল। এতদিনে তার দুটো ছেলে ও একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে মমতাজ কঠিন অসুখে ভুগছে। আসাদ এতগুলো মুখের আহার জোটাবে, না স্ত্রীকে ভালোভাবে চিকিৎসা করাবে? শেষে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে রাজশাহী টাউনে এসে চেষ্টা-চরিত্র করে একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলসম্যানের কাজ নিল। নতুন বলে মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন। সেই টাকাতেই থাকা-খাওয়া করতে হয়। তারপর যা বাঁচে, সেই টাকা নিয়ে মাসে মাসে বাড়িতে আসে।
মেয়ে জামাইয়ের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনে নাদিমের বাড়ির সকলে দুঃখ পেল। কিন্তু তাদের জন্য কিছু করারও তাদের ক্ষমতা নেই। তবু চাষের সময় যখন যে ফসল হয় তা থেকে কিছু কিছু মমতাজকে দেওয়া হয়।
নাদিম মাঝে মাঝে যতটা পারে ছোট বোনের হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে আসে।
আফ্রিদা ছোট মেয়ে মমতাজকে সব থেকে বেশি ভালবাসে। সে মেয়ের সংসারের দুরবস্থার কথা জেনে এবং মেয়ের কঠিন অসুখের কথা শুনে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। গোপনে ছোট ছেলে আবুল খায়েরের হাতে চাল, ডাল, তরী-তরকারী মাঝে মাঝে পাঠায়।
একদিন সাজেদা শাশুড়ীর এই ব্যাপারটা জানতে পেরে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল, অন্য শ্বশুর বা শাশুড়ীরা জানতে পারলে তারা কি সহ্য করবে?
ভয়ে শাশুড়ীকে যেমন কিছু বলতে পারল না, তেমনি স্বামীকেও বলতে পারল না।
একবার আফ্রিদা যখন বাড়ির চাকরের হাতে সের দশেক চাল পাঠাল তখন ছোট জা ফাহমিদা দেখে ফেলে। এক ফাঁকে সে কথাটা সাজেদাকে জানিয়ে বলল, এটা যদি মেজ বুবু দেখত তা হলে খুব খারাপ হত।