আনোয়ারা বলল, বৌমা আসাদের জন্য মমতাজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
রোজীরও মমতাজকে খুব পছন্দ। সে ভাবি হবে শুনে আনন্দে টগবগিয়ে উঠে। বলল, সত্যি বলছ মা?
হ্যাঁ রে সত্যি।
ভাইয়া জানে?
তার মতামত নিয়েই বৌমা প্রস্তাব দিয়েছে।
জান মা, মমতাজ আমার চেয়ে দুক্লাস নিচে পড়ত। ওর সাথে আমার খুব ভাব। ভাবি হলে যা মজা হবে না! মমতাজের সঙ্গে কতবার ওদের বাড়িতে গেছি।
আনোয়ারা বলল, আল্লাহপাক রাজি থাকলে হবে মা। তুই বৌমাকে ও-ঘরে দিয়ে রান্নাঘরে আয়। আমি ভাত বাড়ছি। ওদেরকে খাইয়ে দে, রাত হয়ে যাচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়ার পর নাদিম বাড়ি ফিরতে চাইলে আনোয়ারা বলল, আজ থেকে যাও না বাবা, কাল সকালে যাবে। এত রাতে বৌমাকে নিয়ে যেতে অসুবিধে হবে।
নাদিম বলল, না চাচি আম্মা থাকতে পারব না। বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে। এই এক মাইলের রাস্তা রিকশায় যেতে কতক্ষণ আর সময় লাগবে?
নাদিম স্ত্রীর কাছে আসাদের মায়ের মতামত শুনেছে। ফেরার আগে তাকে বলল, আমাদের কর্তারা একদিন কথাবার্তা বলার জন্য আসবে। কবে আসবেন, আমি জানাব। তারপর আসাদকে জিজ্ঞেস করল, তুই কতদিন থাকবি?
আর এক সপ্তাহ আছি।
ঠিক আছে, এর ভিতরেই ওনাদেরকে আসতে বলব।
আনোয়ারা বলল, তুমিও সঙ্গে এস।
জি আসব বলে সাজেদাকে নিয়ে রওয়ানা দিল।
আসাদ বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে তাদেরকে রিকশায় তুলে দিল। মাস দুয়েকের মধ্যে আসাদের সঙ্গে মমতাজের বিয়ে হয়ে গেল।
৬. মমতাজ শ্বশুর বাড়িতে
মমতাজ শ্বশুর বাড়িতে এসে বছর পাঁচেক বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে ছিল। তারপর তাদের সংসারে কালোছায়া নেমে এল। প্রথমে আসাদের চাকরি চলে গেল। আসাদ সৎ ও ধার্মিক। সহকর্মীরা ও নিম্নতম কর্মচারীরা তার জন্য ঘুষ খেতে পারত না। উপরওয়ালারাও এ ব্যাপারে তার উপর অসন্তুষ্ট। এবারে সে বসের বিরাট অংকের ঘুঘ খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছিল। আর অফিসের দুএকজন ছাড়া সবাই তার উপর অসন্তুষ্ট ছিল। এই সুযোগে সবাই মিলে যুক্তি করে বসের ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দিল। ফলে তার চাকরি চলে যায়। অন্য কোথাও অনেক চেষ্টা করেও কোনো কিছু জোগাড় করতে না পেরে বাড়ি ফিরে এল।
ঘটনাটা জেনে আসাদের মা বলল, আজকাল শিক্ষিত লোকেরা যদি এরকম হয় তা হলে অশিক্ষিত থাকাই ভালো। সরকার রেডিও-টিভিতে যে দেশের লোককে শিক্ষা গ্রহনের জন্য এত গলাবাজি করছে, এত স্কুল-কলেজ তৈরি করছে, সে সব করে কি লাভ হচ্ছে? দেশের সব লোক শিক্ষিত হলে তো সবাই চরিত্রহীন হয়ে দেশটাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবে।
আসাদ বলল, তোমার কথাটা যদিও ঠিক নয়, তবু একেবারে অস্বীকার করতে পারছি না। আসল কথা কি জান আম্মা, যারা দেশের লোককে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে এতকিছু করছে তারাই চরিত্রহীন ও দুর্নীতিবাজ। আর তারা শিক্ষিত হলেও শুধু ডিগ্রী নেয়ার জন্য লেখাপড়া করেছে, শিক্ষা গ্রহন করার জন্য করেনি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা না পেয়ে এবং না মেনে আল্লাহ ও রসুলকে (দঃ) ভুলে গেছে।
আনোয়ারা বলল, তোর দাদাজী বলতেন, ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও সেইমতো অনুশীলন দিয়ে মানুষ না করলে শুধু স্কুল-কলেজের বিদ্যার্জন করালে ক্রমশ তারা বিজাতীয়দের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তারা, চরিত্রবানও হতে পারবে না।
আসাদ বলল, দাদাজী খুব খাঁটি কথা বলেছিলেন।
আসাদ বাড়িতে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করতে লাগল। কিন্তু তাতে করে সংসারে আগের মতো সচ্ছলতা রইল না। ছোট ভাই জাকির মাস্টার ডিগ্রী পড়ার সময় এক বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে গোপনে লাভ ম্যারেজ করেছিল। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা ছোটখাট অফিসে চাকরি নিয়েছিল। শ্বশুর বিয়ের কথা জানতে পেরে এবং জাকিরের পরিচয় পেয়ে প্রথমে মেয়েকে রাগারাগি করে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন, মেয়ে কিছুতেই রাজি হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি জামাইকে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জাকির স্ত্রীকে নিয়ে গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বেতন মোটামুটি বেশ ভালো হলেও স্ত্রীর সব খায়েশ মেটাতে পারে না। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই কলহ লেগে থাকে। এরপর আর দেশে মা-ভাইকে পাঠাবে কি।
আসাদ জানতে পেরে ঢাকায় জাকিরের বাসায় একবার গিয়েছিল। জাকির ভুল স্বীকার করে বড় ভাইয়ের কাছে মাফ চেয়ে টাকা-পয়সা দেয়ার অপারগতার কারণ খুলে বলেছে। সেদিন জাকির ভালো ব্যবহার করলেও তার স্ত্রী আসাদের সঙ্গে কথাও বলেনি। তারপর আসাদ আর ছোট ভাইয়ের কাছে যায়নি।
আসাদের বাপ বাড়ি করার সময় দশ বিঘে জমি গ্রামের এক ধনাঢ্য লোকের কাছে দশ বছরের জন্য সাফকওলা রেখে বিশ হাজার টাকা নিয়েছিল। আসাদ সে খবর জানত না। সে তখন কলেজে পড়ে। সাফকওলার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে সেই লোক কাগজপত্র নিয়ে আসাদের বাড়িতে এসে সব কথা জানিয়ে বলল, গত বছর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমরা এ বছর জমির দখল নিয়ে চাষাবাদ করব। দলিল মোতাবেক আমরা এখন আপনাদের জমির মালিক। তবে আপনি যদি এক মাসের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতে পারেন তা হলে আপনাদের জমি আপনাদের থেকে যাবে। আমি দলিল ফিরিয়ে দেব। আপনার বাবা খুব ভালো লোক ছিলেন, আপনিও শিক্ষিত। যা ভালো বুঝবেন করবেন।